নেত্রকোণায় আগাম জাতের রোপা আমন ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। পাকা ধানের সোনালি শিষে ভরে গেছে ফসলের মাঠ। ধান কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। ভালো ফলন আর দাম বেশি পাওয়ায় খুশি তারা।

তবে সম্প্রতি অক্টোবরের বন্যায় রোপা আমন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ বছর জেলায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ হলেও সম্প্রতি বন্যায় ২৪ হাজার ৬৬৭ হেক্টর রোপা আমন ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে পরিচিত নেত্রকোণায় উচ্চ ফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালীন আগাম জাতের ধানি গোল্ড, ব্রি ধান-৭১ ও ৭৫ ও বিনা-১৬ ও ১৭ ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে এ বছর জেলায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে, যা আবাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৬০ হেক্টর বেশি। যার মধ্যে স্বল্পকালীন জীবনের আগাম জাতের ধানের আবাদ হয়েছে ৩৩ হাজার ৮১৮ হেক্টর জমিতে এবং হাইব্রিড জাতের আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৯৩৫ হেক্টর জমিতে যা গত বছরের চেয়ে ২৫ হাজার ৮০৮ হেক্টর বেশি।

কৃষকরা জানিয়েছেন, এ বছর ফলন তুলনামূলক ভালো হয়েছে। প্রতি মণ ধান বিক্রি করছেন ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা দরে। তবে এ বছর বন্যায় নিচু এলাকার আমন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উঁচু এলাকায় ফলন ও দাম বেশি পাওয়ায় খুশি কৃষকেরা। আগাম জাতের ধান কেটে এই জমিতেই বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষা, আলুসহ শীতকালীন সবজি আবাদ করতে পারবেন তারা। তাই প্রতিবছরই জেলায় বৃদ্ধি পাচ্ছে আগাম জাতের রোপা আমন ধানের চাষ।

জুয়েল রানা নামের নেত্রকোণা সদরের এক কৃষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বিআর-৫০ ধান রোপণ করেছিলাম দুই কাঠা জমিতে। ফলন মোটামুটি ভালো হয়েছে। তবে পানি আসায় ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে আমরা কৃষকরা যদি ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা ধানের দর পাই তাহলে আমরা উপকৃত হব। বাজারে সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী, মানুষের হাতের নাগালের বাইরে। ধানের দামটা যদি একটু ভালো থাকে তাহলে আমরা কৃষকরা লাভবান হব।

সদরের দক্ষিণ বিশিউড়া গ্রামের কৃষক মো. শন্তু মিয়া বলেন, আমরা বিনা-১৭ ধান রোপণ করি। কারণ এটা একটু আগে কাটা যায় এবং ধান কাটার পর অন্য একটি ফসল আমরা আবাদ করতে পারি। তবে এ বছর বন্যার পানির কারণে ফলন কিছুটা কম হয়েছে। বাজারে ধানের দাম ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা আছে, এই দামটা যদি থাকে তাহলে আমরা খুশি।

মোহাম্মদ আলিম উদ্দিন নামের আরেক কৃষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যে ধানটা এখন মাড়াই করছি এটা বিনা-১৭ ধান। অন্যান্য বছর এই ধানের ভালোই ফলন হয়েছে। তবে এ বছর আবহাওয়ার কারণে ফলন কিছুটা কম হয়েছে। তারপরও তুলনামূলক বাজারে ধানের দাম ভালো হওয়ায় কৃষকদের ওপর খুব একটা প্রভাব পড়বে না। পাশাপাশি এই ফসলটা কাটার পর আমরা সরিষা আবাদ করার সময় পাই। অথবা অন্য কোনো একটা কৃষি আবাদ করতে পারি, এজন্যই আমরা এই আগাম জাতের ধানটি রোপণ করি।

দরিজাগি গ্রামের কৃষক মো. মোস্তফা বলেন,আমরা হাইব্রিড জাতের ধানি গোল্ড ও ব্রিধান-৪৯ জাতের ধান রোপণ করেছি। পাশাপাশি কিছুটা জমিতে ব্রি ধান-৩৪ জাতের চিকন ধান রোপণ করেছি। এ বছর আল্লাহ দিলে ধান ভালোই হয়েছে। ধাপে ধাপে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ধানের ফলনটা ভালো হয়েছে। যদিও অন্যান্য এলাকায় বৃষ্টির কারণে বন্যায় অনেকের ধানের ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু আমাদের এদিকে জমি তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় আমাদের বন্যায় ক্ষতি হয়নি বরং বৃষ্টির কারণে আমাদের ধানের ফলন ভালো হয়েছে। ধানের ফলনে আমরা কৃষকরা খুশি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ বছর ধানে রোগ ও পোকার আক্রমণ একবারেই ছিল না। পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে সারের সরবরাহ ভালো থাকায় কৃষকরা সুষম পরিমাণে জমিতে সার ব্যবহার করতে পেরেছেন। যে কারণে ফলন ভালো হয়েছে। যেহেতু এ বছর ধানের ফলন ভালো হয়েছে এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে সে হিসেবে লক্ষ্যমাত্রার খুব কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে।

নেত্রকোণা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নেত্রকোণা জেলায় এ বছর ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যেখানে আমাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৬০ হেক্টর জমি বেশি অর্জন হয়েছিল। তবে অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে পাহাড়ি ঢল এবং অতিবৃষ্টিজনিত কারণে আমাদের এই জেলায় রোপা আমন ফসল আক্রান্ত হয়েছে। সে হিসাবে আমাদের এ জেলায় ২৪ হাজার ৬৬৭ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় আমরা এখন মাঠ পর্যায়ে আমাদের যে রোপা আমন ধান আবাদ করেছিলাম, তার ভেতরে স্বল্প জীবনকালীন এবং উচ্চ ফলনশীল যে জাতগুলো আছে সেগুলো আমরা মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করেছি। এ জাতগুলো আমাদের নেত্রকোণা জেলায় যথেষ্ট পরিমাণে সম্প্রসারিত হয়েছে। আমাদের টার্গেট হলো রোপা আমনের স্বল্পমেয়াদি যে জাতগুলো আছে সেগুলো কাটার পর কৃষক ভাইরা যেন বোরো আবাদের মাঝামাঝি সরিষা আবাদ করতে পারেন। এজন্য তাদেরকে আমরা উদ্বুদ্ধ করি এবং এই কার্যক্রমটি হাতে নিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, এখন মাঠ পর্যায়ে আগাম যে জাতগুলো ছিল সেগুলো কাটা শুরু হয়েছে। এ বছর ধানের রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ একেবারেই ছিল না। পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে সারের সরবরাহ ভালো থাকায় কৃষকরা সুষম পরিমাণে জমিতে সার ব্যবহার করতে পেরেছেন, এ কারণে ধানের ফলন ভালো হয়েছে।

মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, বন্যার কারণে আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের চালের টার্গেট ছিল ৪ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৭ মেট্রিক টন। নেত্রকোণা জেলায় আমাদের ধান উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেশি। নেত্রকোণায় যে পরিমাণ খাদ্যশস্যের চাহিদা তার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি উৎপাদন হয়। সেই হিসাবে আমাদের প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন চাল উদ্বৃত্ত হয়। বন্যায় ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে আমাদের এ জেলার জন্য খাদ্যের জন্য কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। যেহেতু আমাদের এ বছর ধানের ফলন ভালো হয়েছে এবং আমরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৬০ হেক্টর জমি বেশি আবাদ হয়েছে। আমরা আশা করছি আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা আছে তার খুব কাছাকাছি আমরা অর্জন করতে পারব। বন্যার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে সেটা হয়ত অনেকটা কমানোর সুযোগ রয়েছে।

চয়ন দেবনাথ মুন্না/এমজেইউ