‘কলকাকলি স্টেশনে’ থামে ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’
নেই ট্রেনের লাইন, নেই ইঞ্জিন। আছে শুধু আস্ত কয়েকটি ‘বগি’ (কোচ)। সঙ্গে যাত্রী বেশে শিশু শিক্ষার্থীরা। ট্রেনের একেকটি বগি একেকটি ক্লাসরুম। এমন ক্লাসরুমগুলোতে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কমলমতিদের পাঠদান করেন শিক্ষকরা। ট্রেনের বগির আদলে ক্লাসরুমগুলো রঙ করা নিয়ে জেলায় বেশ সাড়া পড়েছে।
বলছিলাম রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা। বিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে ১৯৬৭ সালে। এরপরে ২০০০ সালে কয়েকটি ক্লাসরুম নির্মাণ করা হয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে। তবে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুরানো ভবন আন্তঃনগর ট্রেনের বগির আদলে রঙ করা হয়েছে। যা দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন ট্রেনের কয়েকটি বগি দাঁড়িয়ে আছে ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে অংশে ট্রেনের বগির মতো রঙ করা হয়েছে সেগুলোর আলাদা নাম দেওয়া হয়েছে। এখানে ট্রেনের নাম ও স্টেশনের আলাদা আলাদা নাম রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়- কোথা থেকে কোথায় যাত্রা করবে তাও নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্টেশনের নাম ‘কলকাকলি স্টেশন’। ট্রেনের নাম ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’। গন্তব্য দেওয়া হয়েছে বিদ্যালয়-টু-মহাকাশ। এখানে বিদ্যালয় মনে বোঝানো হয়েছে ‘ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান আহরণ করে যাবে মহাকাশে। তাই মহাকাশ দূরত্ব অর্থে বোঝানো হয়েছে। কোমলমতি শিশুরা তাদের জীবনের যাত্রা শুরু করবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এই যাত্রাতে পৃথিবীর জ্ঞান অর্জন করে সুদূর মহাকাশ পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণের লক্ষ্যে ধাবিত হবে।
আরও পড়ুন
জানা গেছে, এই বিদ্যালয়ে ৩০৯ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, ছাত্র ১৩৮ জন ও ছাত্রী ১৭১ জন। তাদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ১৫ জন ছাত্র ও ২৯ জন ছাত্রী, প্রথম শ্রেণিতে ২৩ জন ছাত্র ও ২৫ জন ছাত্রী, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩৪ জন ছাত্র ও ২৩ জন ছাত্রী, তৃতীয় শ্রেণিতে ২৭ জন ছাত্র ও ৩৮ জন ছাত্রী, চতুর্থ শ্রেণিতে ২৪ জন ছাত্র ও ২৭ জন ছাত্রী এবং পঞ্চন শ্রেণিতে ১৫ জন ছাত্র ও ২৮ জন ছাত্রী পড়াশোনা করে। এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণিতি একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছাত্রীও পড়াশোনা করে।
শিক্ষার্থী রাফিয়া জানায়, তাদের এই ট্রেন গাড়িতে ক্লাস করতে ভালো লাগে। তাদের স্কুলের মতো ট্রেন গাড়ি কোনো স্কুলে নেই। তাদের শিক্ষকরা ট্রেন গাড়ি নিয়ে বলেছেন যে, ট্রেনের একটা নাম থাকে, স্টেশন থাকে এবং কোথায় থেকে যাবে ও কোথায় থামবে তাও থাকে।
শুধু তাই নয়, এই স্কুল ও স্কুলের প্রধান শিক্ষকের হাত ধরে এসেছে বেশ কিছু সম্মাননা ও পদক। ‘ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে সক্ষম হয়েছে এমন বিদ্যালয়’ ক্যাটাগরিতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০২২ এ ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ‘প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২২’ পেয়েছেন। সৃজনশীলতা দিতে সততা স্টোর, মহানুভবতার দেয়াল, কলম ব্যাংক, দেয়ালিকা, হাতেখড়ি উৎসব, চালু হয় মিড ডে মিলসহ শিক্ষা ও আনন্দের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন।
আব্দুর রাকিব নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, স্কুলটা অনেক পরিপাটি। স্কুলের ক্লাসরুমগুলো ট্রেনের মতো তা শিক্ষার্থীদের আরও আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। বাইরে থেকে দেখতেও ভালো লাগে। মনে হয় স্কুল মাঠে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রতনা খাতুন বলেন, স্কুলে পাশাপাশি দুইটা ভবন ও মাঝে খেলার মাঠ আছে। পশ্চিমের ভবনে ২০০০ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এই ভবন প্রতিষ্ঠার সময় সেটির অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তাই শিক্ষার্থীরা সেখানে ক্লাস করতে চাইতো না। আমরা প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন রূপ দিতে রঙ করার পরিকল্পনা করি। প্রথমে আমরা বিভিন্ন ডিজাইন করার বিষয়ে ভেবেছিলাম। পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক বললেন- আমরা এমন কিছু করব যাতে করে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান আহরণ করতে পারে। তারই অংশ হিসেবে ট্রেনর বগির আদলে ক্লাসরুমের সামনের দেয়াল রঙ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবা খাতুন বলেন, আমরা চাচ্ছিলাম শিক্ষার্থীদের অন্যরকম কিছু উপহার দিতে। আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল ক্লাসরুমটা এমন করা যাতে শিক্ষার্থীদের ভালো লাগে। সেই চিন্তা থেকেই ট্রেনের বগির আদলে রঙ করা হয়েছে। এই ট্রেনের বগিগুলো শুধু বগি না, এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ম্যাসেজ দেওয়া হয়েছে। যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট কোড, সারদা পুলিশ এ্যাকাডেমির কোর্ড, পুঠিয়ার কোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, পড়াশোনা ও স্কুলে আসার প্রতি শিক্ষার্থীরা অমনোযোগী ছিল। তবে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও পাসের হার ভালো। এ থেকে আমার কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনা। আমরা সেটা পেরেছি। শিক্ষার্থীরা স্কুলে এসে সব ধরনের বিনোদন পায় পড়াশোনা করার স্বার্থে। এখানে নয়জন শিক্ষক আছেন। তারমধ্যে একজন পুরুষ ছাড়া বাকিরা নারী শিক্ষক।
এ বিষয়ে কথা বলতে পুঠিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবিএম ছানোয়ার হোসেনকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এফআরএস