পলিথিনে মোড়ানো ‘সংসার’ অভিরাম-শ্যামলী দম্পত্তির
পুকুর পাড়ে বাঁশঝাড়ের নিচে পলিথিনে মোড়ানো ছোট্ট একটা ঘর। যেখানে বসবাস করছেন অভিরাম সরকার (৬২) ও তার অসুস্থ প্রতিবন্ধী স্ত্রী শ্যামলী। নড়বড়ে পলিথিনে মোড়ানো এই ঘরে রোদ, বৃষ্টি, পোকামাকড়ের মাঝেই গত দুই বছর ধরে বসবাস করছেন ভূমিহীন অসহায় এই দম্পত্তি।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার অলোয়া ইউনিয়নের চরনিকলা এলাকায় গেলেই বাঁশঝাড়ের নিচে পলিথিনে মোড়ানো ছোট্ট ঘরে অভিরাম ও শ্যামলী দম্পত্তির দেখা মেলে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা গেছে, অভিরাম সরকার উপজেলার চরনিকলা গ্রামের পূর্ণ সরকারের ছেলে। পরিত্যক্ত একটি পুকুর পাড়ের বাঁশঝাড়ে নিচে তাদের ছোট্ট ঘরটিও তৈরি করা হয়েছে গ্রামের প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় ৬টি টিন ও শোলার (পাটখড়ি) বেড়ার ওপর পলিথিন দিয়ে। ছাপড়ার পাশেই একটি মাটির রাস্তা। ওই রাস্তা দিয়ে আশপাশের মানুষজন চলাচল করে। টিন জং ধরায় পলিথিন মোড়ানো হয়েছে চালে যাতে বৃষ্টিতে ঘরে পানি না পড়ে। তারপরও বৃষ্টি হলে পানি পড়ে অভিরামের পাটখরির ঘরে। রাস্তার পাশে পলিথিনে মোড়ানো একটি শৌচাগার। এসেবের মাঝেই অসুস্থ প্রতিবন্ধী স্ত্রী শ্যামলীকে রেখেই কাজে যেতে হয় অভিরামকে।
জানা গেছে, অভিরাম সরকার ও শ্যামলী দম্পত্তির ঘরে চৈতন্য নামের এক ছেলে এবং ও গৌড়ি নামের এক মেয়ে রয়েছে। বাড়ির জায়গা-জমি বিক্রি ২০০৪ সালে সপরিবারে ভারত পারি জমান। সেখানে জায়গা কিনে কাজ করে ছেলে মেয়েদের বড় করেন। মেয়েকে বিয়ে দেন সেখানেই। এরপরই হঠাৎ একদিন তার স্ত্রী শ্যামলী বিদ্যুৎস্পৃষ্টে গুরুত্বর আহত হয়। সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি শ্রবণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। পরে বিগত প্রায় ১০ বছর আগে ভারতে থাকা বাড়ি ও ছেলেকে রেখে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে দেশের বাড়িতে চলে আসেন।
আরও পড়ুন
কারণ ছেলে বিয়ে করায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে আর ভাত দিতে চায় না। সহায়-সম্বল না থাকায় দেশের বাড়িতে এসে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু সর্বশেষ দুই বছর আগে কোনো জায়গা না পেয়ে এক আত্মীয়ের পুকুর পাড়ের বাঁশ ঝাড়ের নিচে একটি ছাপড়া তোলে এলাকার লোকজনের আর্থিক সহায়তায়। বর্ষার সময় পুকুর ভরাট হলে পানিতে তলিয়ে যায় তার পলিথিনের মোড়ানো ছাপড়া ঘরটি। এলাকায় তিনি মাছ কিনে বিক্রি করে যা উপার্জন করেন তাতে সংসার চলে না। তার ওপর আবার স্ত্রীর ওষুধ কিনতে হয়। ছেলে ও মেয়েরাও খোঁজ নেয় না বৃদ্ধ বাবা-মাকে। ফলে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
স্থানীয়রা জানান, অভিরাম বংশি নামে পরিচিত। তার বাপ-দাদাদের অনেক সম্পত্তি ছিল। কিন্তু সব কিছু বিক্রি করে পরিবার নিয়ে ভারতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসেছে দেশে। আসার পর অনেকের সাহায্য নিয়ে এখানে ঘর তুলে থাকছে।
চরনিকলা গ্রামের হালিম মিয়া বলেন, জঙলে এভাবে এই যুগেও তাদের বসবাস করতে হচ্ছে। কষ্ট কি সেটা তাদের দেখলে বোঝা যায়। তার ছাপড়া ঘরটি এলাকার মানুষের আর্থিক সহায়তায় হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী না। বৃষ্টির হাত থেকে বাচঁতে পলিথিন দেওয়া হয়েছে। মাছ বিক্রি করে যে কয় টাকা উপার্জন করে তা স্ত্রীর ওষুধ কিনতেই শেষ হয়ে যায়। এমন ভূমিহীনকে সরকার যেন সহায়তা করে।
অভিরাম সরকার বলেন, আমার বড় ভাইও পরিবারসহ ভারতে চলে গিয়েছে। সেই সুবাদে আমিও ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েক বছর সেখানে থাকার পর দেশে চলে এসেছি। ছেলেকে বড় করলেও মানুষ করতে পারিনি। উপার্জন করতে না পারায় ছেলের বউ ভাত দিতে চায় না। তাই অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে দেশে চলে আসছি। থাকার জায়গা না পেয়ে পুকুর পাড়েই আছি। এই বয়সে তেমন কাজ করতে পারি না। হাট-বাজার থেকে মাছ কিনে এনে গ্রামের বাজারে বিক্রি করি। তাতে সংসার চলতে চায় না। কপালের কষ্ট থাকলে সেটা ভোগ করতে হবে। তাই নিয়তি মেনেই কষ্টভোগ করছি। তবে স্ত্রী যদি সুস্থ থাকতো তাহলে কষ্ট কিছুটা হলেও কম হতো। সকালে উঠে রান্না করে স্ত্রীকে সেবাযত্ন ও খাওয়া-দাওয়া করিয়ে বাজারে যাই মাছ কিনতে। আবার বাড়িতে এসে তাকে খাওয়াতে হয়।
চিরনিকলার সাবেক ইউপি সদস্য মোকলেছুর রহমান বলেন, অভিরামের মতো অভাবী মানুষ নেই দেশে অনেক আছে। স্ত্রী অসুস্থ টিনের ছাপড়া তুলে পুকুর পাড়ে থাকে। তার স্ত্রীর একটা প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিয়েছিলাম পরিষদ থেকে মেম্বার থাকার সময়। এখন তার খুবই অভাব। সরকার যদি অসহায় ওই ভূমিহীন দম্পত্তিকে একটা থাকার ঘর করে দেয় তাহলে তারা নিরাপদে থাকতো।
অলোয়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম হাসান বলেন, অসহায় ওই পরিবারের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহযোগিতা করার পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। সরকারি সুবিধাসহ তার থাকার ঘর নির্মাণে টিন দিয়ে সহায়তা করা হবে।
অভিজিৎ ঘোষ/আরকে