এমপি হয়েই পলকের সম্পদের ঝলক
জুনাইদ আহমেদ পলক। নিজ জেলা শুধু নাটোর নয়, দেশের রাজনীতিতে অতিপরিচিত মুখ। মিষ্টি কথা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অর্থ খরচ করে দেখানো উন্নয়নের ফুলঝুরিতে অনেকটা ধামাচাপাই থাকতো প্রভাবশালী পলকের স্বেচ্ছাচারিতা। ধুরন্ধর পলক তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে সিংড়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। আত্মীয়-স্বজন ও অনুগত ব্যক্তিদের পদ দিয়ে নেতা বানান। পলক অনুসারী এসব নেতারাও হয়ে ওঠেন একেকজন মাফিয়া। যাদেরকে সবাই ‘ফাইভ স্টার’ বাহিনী হিসেবে অভিহিত করে।
অপরদিকে ভিন্ন মতের হলেই দলের কিংবা বিরোধী পক্ষের কেউই ছাড় পাননি পলকের হাত থেকে। এমনকি উপজেলা নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে ভোট করান, ত্যাগী আওয়ামী লীগের নেতাদেরকে পদশূন্য করেন জুনাইদ আহমেদ পলক।
বিজ্ঞাপন
নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জুনাইদ আহমেদ পলক। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পরের বার অর্থাৎ ২০১৪ সালে পেয়ে যান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। পলক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠজন হওয়ার সুবাদে আওয়ামী লীগ সরকারের পরের দুই মেয়াদেও (২০১৮-২০২৪) একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এর সঙ্গে ২০১৮ সালে মেয়াদের শেষের দিকে যোগ হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা সবাই গা ঢাকা দেন। ৫ আগস্টের আগে পরে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের অনেকে দেশ ত্যাগ করেন, আবার অনেকে পালাতে গিয়ে আটক হন। এর ভেতর সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ৬ আগস্ট বিকেলে দিল্লি যাওয়ার সময় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। এরপর পলক ও তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকার ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বর্তমানে পলক হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। এরই মধ্যে জন্মস্থান নাটোরের সিংড়া থানাতেও পলকের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে বলে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
গ্রেপ্তারের পর থেকেই বেরিয়ে আসছে পলকের নানা দুর্নীতির খবর। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের নামে একের এক প্রকল্প নিয়ে বাজেট থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ উঠেছে পলকের বিরুদ্ধে। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ। শেখ হাসিনা পুত্রের অত্যন্ত কাছের ব্যক্তি হওয়ার সুবাদে সেইভাবে জবাবদিহিতার প্রয়োজন হয়নি পলকের। আইসিটি খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বিগত সরকারের সময়। কিন্তু এর ফল দেশের জনগণ কতটুকু পেয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
পলকের দুর্নীতির অন্যতম উৎস ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এটুআই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইকেট পার্ক, আইটি পার্ক ইত্যাদি। অভিযোগ রয়েছে এসব খাতে যে কোনো প্রকল্প নিলেই ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো পলক সিন্ডিকেটকে।
জানা গেছে, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি খাতে ২০১০ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের রয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এর মধ্যে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ সারাদেশে ৯২টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করে। গত দুই অর্থবছরে (২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১) বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ৫০ কোটি ৫৮ লাখ ২৭ হাজার টাকার অনিয়ম পায় মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়ের নিরীক্ষা বিভাগ।
অভিযোগ উঠেছে, পরিবারের সদস্যসহ নিজের অনুগত কর্মীদের নামে-বেনামে পলক সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তার নির্বাচনী এলাকায় ও বাইরে। এছাড়াও পলকের নিজেস্ব ‘ফাইভ স্টার’ বাহিনীর সদস্যরাও হয়েছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা পেশায় স্কুলশিক্ষিকা। কিন্তু গেল ১৫ বছরে তিনিও হয়েছেন কোটি টাকার মালিক।
দৃশ্যমান সম্পদ
সিংড়ায় পলক তার পরিবারের সদস্যদের নামে ও বেনামে করেছেন অঢেল সম্পদ। দৃশ্যমান অনেক সম্পদের মধ্যে বড় ছেলে অপূর্ব জুনাইদ এর নামে জামতলী-বামিহাল রাস্তা সংলগ্ন চওড়া গ্রামে লিটন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪২ বিঘা পুকুর ও আম বাগান কিনেছেন, যা চওড়া মৌজার দাগ নম্বর: ১৯০, ১৯১, ১৯২, ১৯৩, ১৯৮, ১৯৯, ২০০, ২০১, ২০২, ২১১, ২১৪, ২১৫, ২৯৩, ৩০৮, ৩০৯, ৩৪৪, ৫৬২ । নিজের মা জামিলার নামে সুকাশ ইউনিয়নে আগমুরশন গ্রামে হেদায়েতুল্লাহ প্রামাণিকের কাছে থেকে ৩৬ বিঘা পুকুরসহ বাগান কিনেছেন, যার খতিয়ান নম্বর: ২০৮, জেএল নম্বর: ১১৩, আগমুরশন মৌজার দাগ নম্বর: ৭০২, ৭৯৬, ৭৯৭, ৭৯৮, ৭৯৯, ৮০০, ৮০১ মোট সাতটি দাগে ১২ একর ২৯ শতক জায়গার মধ্যে ১২ একর মা জামিলার নামে ক্রয় করেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক।
এছাড়াও সিংড়া পৌরসভার উপ-শহর এলাকায় স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা ও শ্যালক লুৎফুল হাবীব রুবেলের নামে রয়েছে কোটি টাকার দুটি পৃথক বিল্ডিং বাড়ি। শহরের মাদারীপুর ও চাঁদপুর রাস্তা সংলগ্ন ১৫ শতক মার্কেটের জায়গা কিনেছেন, যার কাটাপুকুরিয়া মৌজার দাগ নম্বর: ৩৫১। সিংড়া থানা মোড় ও জোড়মল্লিকা এলাকায় শ্যালক রুবেলের নামে রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও শ্যালক রুবেলের নামে ইটভাটা ও গরুর খামার রয়েছে। স্ত্রী কনিকার নামে বড় মাগুড়ি এলাকায় জনৈক ফরজ আলী প্রামানিকের থেকে ৫ বিঘা জমি, জয়বাংলা মোড়ে দেড় শতক জমির ওপর দলীয় অফিস নিজ নামে কেনেন পলক। স্ত্রী কণিকার নামে জোলারবাতা এলাকায় জনৈক আব্দুস সোবাহানের থেকে ১৮ বিঘা কেনেন পলক।
ফাইভ স্টার বাহিনী
সিংড়ায় পলকের শক্তির নিয়ন্ত্রক হিসেবে ধরা হয় ফাইভ স্টার বাহিনীকে। মূলত সিংড়ায় একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করে পলকের ব্যক্তিগত বিশেষায়িত এই বাহিনীটি। এ গ্রুপের সদস্য ছিলেন— ইটালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম, সিংড়ার সাবেক পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ডালিম আহমেদ ডন, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি শরিফুল ইসলাম শরীফ ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি সোহেল তালুকদার। এর ভেতর ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তোলার কয়েক বছর পরই শরিফুল ইসলাম শরিফের সঙ্গে পলকের মতপার্থক্য হওয়ায় তাকে পদ-পদবি থেকে বঞ্চিত করে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এক সময় কিছুই না থাকা ফাইভ স্টার বাহিনীর সদস্যরা জুনায়েদ আহমেদ পলকের সংস্পর্শে এসেই বনে যান আঙুল ফুলে কলাগাছ। নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছচাষ, অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন, সরকারি জায়গা দখল করে দোকান বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে চাঁদাবাজি, ডিও ব্যবসা, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য ছিল ফাইভ স্টার বাহিনীর অবৈধ আয়ের উৎস। তবে বাহিনীটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল জুনাইদ আহমেদ পলকের বিরোধী শক্তিকে যেকোনো মূল্যে দাবিয়ে রাখা। ফাইভ স্টার বাহিনীর একেকজন সদস্যের আলাদা আলাদা শাখা গ্রুপ ছিল। যারা এ সকল কার্যক্রম ভিন্ন ভিন্ন ভাবেই পরিচালনা করতেন।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এসব বাহিনী তাদের শক্তির জানান দেয়। নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা, তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর এমনকি ভোটের আগে প্রতিপক্ষের সমর্থকদের এলাকা ছাড়া করতো এই বাহিনী। শুধু তাই নয়, পলকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে এমন বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের ওপর আচমকা নেমে আসতো হামলা। বিশেষ করে যে কোনো নির্বাচনের আগে ধারাবাহিকভাবে চালানো হতো এসব হামলা।
গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের ঘটনা। ১০ নভেম্বর শুক্রবার নাটোরের সিংড়ার ছাতারদীঘী ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আব্দুর রাজ্জাক নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরছিলেন। পথেই তাকে থামিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে পিটিয়ে দুই পা ভেঙে রক্তাক্ত করে পার্শ্ববর্তী নন্দীগ্রাম উপজেলার একটি সড়কের পাশে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা।
ওই হামলাসহ বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর চোরাগুপ্তা হামলায় ফাইভ স্টার বাহিনীর সম্পৃক্ততা ছিল বলে সূত্র জানিয়েছে। জুনাইদ আহমেদ পলক বিমানবন্দর থেকে আটক হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়াতেই গা-ঢাকা দেন ফাইভ স্টার বাহিনীর আলোচিত এই পাঁচ সদস্য।
পলকের হলফনামা যা বলছে
২০০৮ সালের নির্বাচনে ধারদেনা করে খরচ জোগানো জুনাইদ আহমেদ পলকের কাছে ছিল নগদ ৩০ হাজার এবং স্ত্রীর ছিল ৫০ হাজার টাকা। নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা ২০২৪ সালের (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন) হলফনামায় পলক উল্লেখ করেছেন, তার কাছে নগদ টাকা আছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪১ হাজার ১১২ টাকা। তার স্ত্রীর কাছে আছে ৪৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯১ টাকা।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জুনায়েদ আহমেদ পলককে তার স্বজনরা দান করেছিলেন ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর পাঁচ স্বজনের কাছ থেকে ধার করেছিলেন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। নিজের বলতে সেবার পলকের স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে সম্পদ ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার টাকার। অন্যদিকে তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার।
দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে হলফনামা অনুযায়ী পাঁচ বছরে পলকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়ে হয় ৬৬ লাখ ৪৩ হাজার ২৬ টাকা এবং তার স্ত্রীর ৭৭ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৩ টাকা।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামায় তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়ে হয়েছিল ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা আর তার স্ত্রীর ছিল ৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় পলক স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে এসে তার স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে পলকের সম্পদ বেড়েছে ১৪০ গুণ। আর পলকের স্ত্রীর বেড়েছে ১৬২ গুণ।
পলকের উত্থান
অত্যন্ত প্রতাপশালী জুনাইদ আহমেদ পলকের রাজনৈতিক উত্থান সম্পর্কে জানতে যেতে হবে একটু পেছনের দিকে। রাজনীতির শুরু থেকেই ধুরন্ধর পলক ২০০৬ সালের তৎকালীন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে শেখ হাসিনার বাস ভবনের সামনে অবস্থান নেন। পরে আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। সে সময় আসনটিতে দলের মনোনয়ন পাওয়া তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ আলী শেখের বিপক্ষে যায় এমন কথা মুখরোচকভাবে তুলে ধরলে পরবর্তীতে পলক নৌকার মনোনয়ন লাভ করে। পরবর্তীতে নির্বাচন পিছিয়ে ২০০৮ সালে হলে তখনও তিনি মনোনয়ন পান।
ত্যাগী আ.লীগ নেতাদের কোণঠাসা
পরপর টানা চতুর্থবারের মতো সংসদ সদস্য হন জুনাইদ আহমেদ পলক। এর মধ্যে তিনবারই মন্ত্রী পরিষদের সদস্য। বিরতিহীন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দলের ভেতরে তার বিরুদ্ধে যায় এমন নেতাকর্মীদের কঠোর হাতে দমন করেছেন তিনি।
গত ২০১৯ সালের ১০ মার্চ সিংড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যে সকল নেতৃবৃন্দ নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী শফিকুল ইসলাম শফিকের ভোট করেছে তাদেরকে পরবর্তী উপজেলা আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গ সগঠনের কাউন্সিলে পদশূন্য করা হয়। মূলত শফিকুল ইসলাম শফিক-ই ছিলেন আসনটিতে পলকের বিপক্ষে দলীয় একমাত্র শক্তিশালী প্রতিপক্ষ।
সেই ভোটে নৌকার পক্ষে (শফিকুল ইসলাম শফিকের) ভোট করায় পরবর্তীতে পদ হারানো নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন— উপজেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক খলিলুর রহমান, উপ-দপ্তর সম্পাদক রেজাউল করিম রেজা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক জালাল উদ্দিন, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ দুদু, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান কামরান প্রমুখ।
এ বিষয়ে উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিংড়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান কামরুল হাসান কামরান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু নৌকার পক্ষে ভোট করায় ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে অসংখ্য নেতাদেরকে পদ থেকে সরিয়ে দেন জুনাইদ আহমেদ পলক। একচ্ছত্র আধিপত্য রাখতে বিগত ১৫ বছর ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে রাখেন তিনি। তার নিজস্ব সিন্ডিকেটের লোকজনকে দিয়ে দল পরিচালনা করেছেন। আমি মনে করি পলক সাহেবদের মতো নেতৃত্বের কারণেই আজকে আওয়ামী লীগের এমন অবস্থা।
বিরোধী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সিংড়া উপজেলার বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিজের কব্জায় রেখেছিলেন পলক। বিগত সময় পলকের অনুগত, বিরোধী রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাদের ব্যবহার করে পুরো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে অকার্যকর করে রাখা হয়।
স্থানীয় বিএনপি সূত্রে জানা যায়, প্রভাবশালী কিছু নেতাকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে নিজের সুবিধামত বিএনপিকে ব্যবহার করে নিজের প্রভাব ধরে রেখেছিলো পলক। যা বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে ওপেন সিক্রেট ছিল।
নাম না প্রকাশের শর্তে উপজেলা বিএনপির এক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পলক সাহেব তার বিরুদ্ধে যায় এমন সবাইকেই হামলা মামলা দিয়ে চাপে রাখতেন। আর যারা তার পক্ষে ছিল সে যদি বিরোধী দলের ও হয় তাদেরকে সুযোগ সুবিধা দিতেন। এভাবে বিএনপির একটি স্বার্থন্বেষী মহল সিংড়া উপজেলা বিএনপিকে অকার্যকর করে রাখে। তারা মূলত পলকের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার পলকের
পলকের ক্ষমতার অপব্যবহার ছিল সর্বমহলে। নিজের আত্মীয়-স্বজনকে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি বানাতেও পলক তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। যার প্রমাণ মেলে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে। পলক তার শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেলকে সিংড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করার জন্যও উঠে পড়ে লাগেন। ঢাকার বাড়িতে মিটিং করে অন্য কাউকে নির্বাচনে না দাঁড়ানোর নির্দেশনাও দেন তিনি। পরবর্তীতে দেলোয়ার হোসেন পাশা নামে আওয়ামী লীগের একজন মনোনয়ন তুললে শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেল কর্তৃক তাকে অপহরণ করে মারধর করা হয়। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসলে দলীয় চাপে বাধ্য হয়ে পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।
পলকের ক্ষমতার অপব্যবহারে সরকারি কর্মকর্তাদেরও হেনস্থার শিকার হতে হয়। ২০২৩ সালের ১৩ আগস্টের ঘটনা। সিংড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে আয়োজিত গণশুনানিতে জনসম্মুখে তৎকালীন সিংড়া থানার ওসির ওপর সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর কারণ ছিল তৎকালীন ওসি মিজানুর রহমান গণশুনানিতে তার (ওসির) বিরুদ্ধে এক ব্যক্তি অভিযোগ করলে তিনি, আইনের ভেতরে যেভাবে কাজ করা যায় সেভাবেই কাজ করতে চান বলে জানান।
ওসির এমন বক্তব্যের পরেই জুনাইদ আহমেদ পলক তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ওই গণশুনানির ভিডিও প্রতিমন্ত্রী পলক নিজের ফেসবুকেও শেয়ার দেন। ওই ঘটনার জেরে সেদিন (১৩ আগস্ট) রাতেই নাটোরের তৎকালীন পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম ওসি মিজানুর রহমানকে নাটোর পুলিশ লাইন্সে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশনা রাতেই ওসির কাছে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় সেসময় সারাদেশে পুলিশের ওসিরা ক্ষুব্ধ হন। পরে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের দাবিতে আদেশ প্রত্যাহার করে ওসিকে সিংড়া থানায় পুনর্বহাল করা হয়।
যা বলছেন পলকের স্ত্রী
জুনাইদ আহমেদ পলক বিভিন্ন মামলায় জেলে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। পরে সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলতে এই প্রতিবেদক পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকার হোয়াটসঅ্যাপে নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে সম্প্রতি একটি ইউটিউব চ্যানেলে লাইভে এসে কনিকা বলেন, আমাদের দেশের বাহিরে বিদেশে কোনো বাড়ি গাড়ি- সম্পদ কিছুই নেই। এটা বাংলাদেশ সরকার তদন্ত করছে, বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়ে। তারা নিশ্চয়ই সেটা জানতে পারবে। সিংড়ার বাড়িটি পলকের নামে ১৯৯৩ সালের দিকে আমার শ্বশুড় দিয়েছিলেন। পলক পৈতৃক সূত্রে যে সম্পদ পেয়েছিল এখন সেটুকুও নেই। রাজনৈতিক কাজে সব ব্যয় করেছে। এখন এমপি কোটায় পাওয়া একটি প্লট ও একটি গাড়ি রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন মিডিয়াতে বলা হচ্ছে আমি টিউশনি করে ১৮-২০টা ফ্ল্যাট করেছি। কিন্তু সেগুলো কোথায়, আমাকে দেখাক সেগুলো। এতো কিছুই যদি থাকতো তাহলে পলকের মামলার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হতো না। আমার বৃদ্ধ শাশুড়ি-ননদ এবং তিনটা বাচ্চার খাবারের চিন্তা এখন আমার করতে হচ্ছে।
আরএআর