‘আমি ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিছিলকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করছিল। আমি সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য রাজা রামমোহন ক্লাবের বাম পাশের গলি দিয়ে বাজারে ঢোকার চেষ্টা করি। এ সময় আমার কাছ থেকে মাত্র ১০-১৫ ফুট দূরে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক যুবক মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগে আমারও বাম হাঁটু এবং বাম হাতে গুলি লাগে। গুলিটি বাম হাঁটু ও বাম হাত ভেদ করে বের হয়ে যায়। প্রাণ বাঁচাতে আমি কোনোরকমে ফল বিক্রির গলির মাথা পর্যন্ত আহত অবস্থায় এগিয়ে যাই। এরপর আর কিছু মনে নেই। রাতে জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালের বেডে।’

অশ্রুসিক্ত চোখে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ঊনত্রিশ বছর বয়সী মমদেল হোসেন। মাত্র সাড়ে তিন মাস আগেও মমদেল হোসেন একজন পরিশ্রমী এবং উদ্যমী যুবক ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বুলেটবিদ্ধ হয়ে তিনি এখন বিপর্যস্ত। কারণ বাম পা হারিয়ে মমদেল এখন পঙ্গু, অসহায়।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই রংপুর সিটি বাজার এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগসহ তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন মমদেল হোসেনসহ আরও অনেকে। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহত মমদেল হোসেনের বাঁ পাশের হাঁটুর নিচের অংশ এবং বাঁ হাতের তিনটি আঙুল কেটে ফেলা হয়।

মমদেল হোসেন রংপুর মহানগরীর আলমনগর খামার চুড়িপট্টি বস্তির রেললাইনের ধারঘেঁষা একটি ছোট্ট ঘরে বসবাস করছেন। ঘরে তার ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জমিলা বেগম (২৪) ও জাহিদ হাসান (৭) নামে এক ছেলে সন্তান রয়েছে। পুলিশের গুলিতে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে নেওয়া মমদেলের পরিবারে নেমে এসেছে এক ভয়াবহ অন্ধকার।

অথচ কত স্বপ্ন ছিল মমদেলের দু'চোখে। অনাগত সন্তানসহ পুরো পরিবার ঘিরে তার ছোট ছোট স্বপ্ন ছিল। সন্তানদের শিক্ষিত করবেন। পরিবারকে গুছিয়ে নিতে প্রচুর পরিশ্রম করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধিবাম, গুলিতে বাম পা হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন তরুণ এ ওয়েল্ডিং শ্রমিক।

সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় মমদেল ও তার স্ত্রী জামিলা বেগম তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। 

দিন এনে দিন খাওয়া অভাব অনটনের সংসারে উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় কষ্টের কথা তুলে ধরে মমদেল হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ধরে তার বৃদ্ধ বাবা কবির হোসেন (৭০) হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। মমদেলের মা মনোয়ারা বেগম (৫৫) ও তার বাবা শহরের অদূরে ভুরারঘাট গ্রামে বসবাস করেন। মনোয়ারা বেগম বিভিন্ন স’মিল ও কাঠের দোকান থেকে কাঠখড়ি এনে বিক্রি করে সামান্য কিছু আয় করেন। তা দিয়ে কোনোমতে চলে তাদের সংসার।

চার ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ মমদেল। তার বড় বোন গৃহবধূ কোহিনূর বেগমের (৩৮) স্বামী সাজু মিয়া একজন শ্রমজীবী। এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানকে নিয়ে তারা অভাব-অনটনের মধ্যে একই বস্তিতে বাস করেন। মমদেলের মেজ বোন লাবনী বেগমের (৩৫) দিনমজুর স্বামী এরশাদ মিয়াও দুই ছেলে সন্তানকে নিয়ে মহানগরীর বাস টার্মিনাল এলাকায় বসবাস করেন। আর মমদেলের বড় ভাই দিনমজুর শের আলী মধু (৩২) তার স্ত্রী, দুই সন্তানকে নিয়ে বস্তিতে বাস করেন।

মমদেল ২০১৬ সালে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পাটেশ্বরী গ্রামের জামিলা বেগমকে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি আলমনগর খামার চুড়িপট্টি বস্তিতে বাস করছেন। এর মাঝে তাদের ছেলে সন্তান জাহিদ হাসানের জন্ম হয়। ওয়েল্ডিং শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যা বেতন তা দিয়েই চলছিল তাদের সংসার। বর্তমানে তার স্ত্রী জামিলা ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ছেলে জাহিদ হাসান তাদের বস্তি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গ্রামীণ উন্নয়ন কেন্দ্র (গাক) নামের একটি এনজিও পরিচালিত শিশু বিকাশ কেন্দ্রে প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন সবখানে ছড়িয়ে পড়ে ১৬ জুলাই আবু সাঈদের মৃত্যুর পর থেকে। তখন ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে উত্তাল ছিল রংপুর। আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার পর দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার আন্দোলন অগ্নিগর্ভ রূপ নেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত এক দফার দাবিতে পরিণত হয়। আরও উত্তাল হয়ে ওঠে রংপুর। নগরীজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সরকার দলীয় সংগঠনগুলোর পাশাপাশি পুলিশের আক্রমণ, গুলিবর্ষণ, বর্বরতা ও নির্যাতন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।

গুলিবিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে মমদেল হোসেন বলেন, ‘১৯ জুলাই সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বরাবরের মতো নাশতা হিসেবে ভাত খাই। এরপর হেঁটে হেঁটে এক কিলোমিটার দূরের আমার কর্মস্থল লালবাগ বাজারের চৌকিহাটি এলাকায় নূর মেটাল ওয়ার্কশপে যাই। ওয়ার্কশপ সেদিন বন্ধ ছিল।সংসারে অভাবের কারণে আমি সবসময় কাজ করার চেষ্টা করতাম। ওই সময় রংপুর স্টেডিয়ামে আগে থেকেই আমাদের ওয়ার্কশপের ওয়েল্ডিং কাজ চলছিল। ওই দিন ওয়ার্কশপ বন্ধ থাকায় আমি কিছু কাজের আশায় রংপুর স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য বিকেল ৩টায় বস্তি থেকে রওনা হই। ওখানে গিয়ে দেখি স্টেডিয়ামেও কাজ বন্ধ ছিল। আবার বাড়ি ফেরার জন্য হেঁটে রওনা দিই। সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় আমি রংপুর সিটি বাজারের কাছে রাজা রামমোহন ক্লাব মার্কেটের সামনে পৌঁছে দেখি সেখানে নগরীর প্রধান সড়কে সর্বত্রই বিপুলসংখ্যক মারমুখী পুলিশ ও অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে বিক্ষোভকারী হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর হামলা, লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ এবং গুলি বর্ষণ করছেন। সেখানে এক শ্বাসরুদ্ধকর ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রাণে বাঁচার জন্য লোকজন ছুটতে থাকে। ওইদিন সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে আজ পঙ্গুত্ব বরণ করতে হলো।

মমদেলের স্ত্রী জামিলা বলেন, ১৯ জুলাই মেডিকেল থেকে তখন রাত ৮টায় আমার স্বামীর মোবাইল থেকে কেউ একজন আমাকে কল দিয়ে খবর দেন। আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার স্বামী অচেতন অবস্থায় রয়েছে। রাত ৯টায় ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে আমার স্বামীর জ্ঞান ফেরে। তার শরীরে তিন ব্যাগ রক্ত লেগেছে।

তিনি আরও বলেন, পরদিন ২০ জুলাই সন্ধ্যায় চিকিৎসকের পরামর্শে স্বামীকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। ধারদেনা করে ১৫ হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নিয়ে গিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে চিকিৎসকরা রড দিয়ে খাঁচার মতো বানানো নেট দিয়ে গুলি লাগা হাঁটুর অংশ ঢেকে দেন। এরপর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হাঁটুর মাংস সবল আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য আমার স্বামীকে সেখানে নিয়ে যেতে বলেন।

পুলিশের বাধার মুখে ওষুধ কিনতে না পারার দুঃখ প্রকাশ করে জামিলা বলেন, ২১ জুলাই বিকেলে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে স্বামীকে নিয়ে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে যাই। সেখানে সন্ধ্যার আগে চিকিৎসক এসে দেখার পর পায়ের মাংস পরীক্ষা করার জন্য কিছু ওষুধ লিখে দেন। ওই ওষুধ আনার পরে মাংস পরীক্ষা করা হবে। ওষুধ নিতে আমার স্বামীর দুই মামা খোকন এবং নাজমুলসহ আমি গেট থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠি। সেখানে থাকা পুলিশ আমাদের জিজ্ঞাসা করে কীসের রোগী, কোথা থেকে নিয়ে এসেছেন ইত্যাদি। আমি মিথ্যা কথা বলি যে আমার স্বামী সিএনজি অ্যাক্সিডেন্টের রোগী। তখন পুলিশ জোর করে কাগজগুলো হাতে নিয়ে বলে এই রোগী তো গুলিবিদ্ধ। আমাদের আটকে দেয়। ওষুধ কেনার জন্য আর যেতে পারলাম না। পুলিশের আগ্রাসী ভাব দেখে ভয়ে আমাদের দুই মামা সেখান থেকে পালিয়ে যান। কোনো উপায় না দেখে আমি ওষুধ ছাড়াই ফিরে আসি।

তিনি বলেন, ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে না পারায় ও পুলিশের ভয়ে আমরা ঢাকা থেকে পালিয়ে রংপুর চলে আসি। তখন টেস্ট রিপোর্ট ও অন্য কাগজপত্র পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে থাকায় আমরা সেগুলো সঙ্গে আনতে পারিনি। এরপর ডক্টরস কমিউনিটি হাসপাতালে আমার স্বামীকে ভর্তি করাই। এখানেও ভর্তির সময় মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। কারণ গুলি লাগার কথা শুনলে পুলিশি ঝামেলার ভয়ে ভর্তি করবে না। এই হাসপাতালে ডাক্তাররা পায়ের মাংস ঠিক করার জন্য তিন দিন আমার স্বামীর চিকিৎসা করেন। এতে করেও পায়ের মাংসপেশিতে কোনো অনুভূতি সৃষ্টি না হওয়ায় ডাক্তার পা কেটে ফেলতে বলেন। কারণ মাংসে পচন ধরে গ্যাংগ্রিন হয়েছিল।

মমদেল হোসেন বলেন, পা কেটে ফেলার বিষয়টি তখন আমি আমার মা-বাবাকে জানাই। আমার বেঁচে থাকার স্বার্থে তারাও সম্মতি দেন। পরে ২৫ জুলাই সেখানে আমার বাম হাঁটুতে সার্জারি করে হাঁটুর খানিকটা ওপর থেকে নিচের সব অংশ কেটে ফেলা হয়। আমি পঙ্গু হয়ে যাই। জীবনে কখনো ভাবিনি আমাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে।

এদিকে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। শোচনীয় পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর ২৫ আগস্ট মমদেল হোসেনের মামা কাশেম বাদী হয়ে ৮০ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা চেষ্টার মামলা করেন। এতে অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে