শরীরে ৭ গুলি
পুরো পরিবার চালানো সুজন এখন অন্যের সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতেও পারেন না
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান খালেদ মাহমুদ সুজন। বাবা শাহিন কাদের ও বড় ভাই সোহান হোসেন দুজনই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। এর ফলে পড়ালেখার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই সংসারের হাল কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে সুজনকে। কিন্তু গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ছোড়া গুলিতে তাও শেষ হয়ে গেল। প্রায় ১০টি গুলি লাগে সুজনের শরীরে। এর মধ্যে একটি পিতলের তাজা গুলি তার পেটের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে লিভারে আটকে যায়। পরে অস্ত্রোপচারের (অপারেশন) মাধ্যমে তা বের করা হয়। কিন্তু শরীরের ভেতরে এখনো সাতটি ছররা গুলি রয়ে গেছে। এর ফলে বাম হাত ও বাম পা পুরোই প্যারালাইজড হয়ে আছে। এ ছাড়া ডান পা ও ডান হাত ভালো থাকলেও নেই কোনো শক্তি। এমন অবস্থায় পরিবারের হাল কাঁধে নেওয়া সেই উদ্যমী সুজন এখন অন্যের সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতেও পারে না। যার কাঁধে ভর করে চলতো পুরো পরিবার, সেই আজ শয্যাশায়ী। এতে অন্ধকার নেমে এসেছে পরিবারে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররুহিতা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চররুহিতা গ্রামের তাজুল ইসলাম ভূঁইয়া বাড়িতে গিয়ে ঘরে ঢুকতেই খাটের ওপর বসে থাকতে দেখা যায় সুজনকে। তার বড় ভাই সোহান তাকে গেঞ্জি পরিয়ে দিচ্ছেন। পরে তায়াম্মুম করে তিনি আসরের নামাজ আদায় করেন। এ সময় তিনি তার ভাই সোহান ও প্রতিবেশী ভাতিজা রাহিদুল ইসলাম মেহেরাজকে ডেকে আনেন। একপর্যায়ে মেহেরাজ তাকে জুতা পরিয়ে দেন এবং তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসেন।
বিজ্ঞাপন
কথা বলে জানা গেছে, দেশে সুজনের আর কোনো চিকিৎসা নেই বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। শরীরে থাকা গুলিগুলো বের করতে হলে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু অর্থসংকটের কারণে তার বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব নয়। এতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন সুজনসহ তার স্বজনরা।
সুজন চররুহিতা গ্রামের তাজল ইসলাম ভূঁইয়া বাড়ির শাহীন কাদের ও আমেনা বেগম দম্পতির মেজো ছেলে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি চররুহিতা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছাত্রশিবিরের উপ-শাখার সভাপতির দায়িত্বে আছেন।
ঢাকা পোস্টকে সুজন বলেন, বাবা ও ভাইয়া প্রতিবন্ধী হওয়ায় নবম শ্রেণিতে পড়ালেখা অবস্থায় পরিবারের হাল ধরতে একটি দোকানে কাজ শুরু করি। ২০২৩ সালে লক্ষ্মীপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে এসএসসি পাস করি। এখন লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের আওতায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত আছি। লেখাপড়ার পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর শহরের পুরাতন আদালত সড়কে একটি ক্রোকারিজ দোকানে কাজ করতাম। এখন অসুস্থ হওয়ায় তাও বন্ধ।
আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৪ আগস্ট এক দফা দাবি পূরণে লক্ষ্মীপুরে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয় বিপুল সংখ্যক জনগণ। একইদিন শহরের উত্তর তেমুহনী এলাকায় কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনগুলো। যদিও ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল মাদাম ব্রিজের পূর্ব পাশ থেকে ঝুমুর এলাকায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সকাল থেকেই ছাত্রদের ওপর মারমুখী আচরণ শুরু করে। প্রথমে বাগবাড়ি এলাকায় ও পরে মাদাম ব্রিজ-ঝুমুরে গিয়ে ছাত্রদের মারধর করে। আওয়ামী লীগ-যুবলীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। এদিকে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনা দেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ জনগণ তাদেরকে প্রতিহত করা শুরু করে। একপর্যায়ে মাদাম ব্রিজ এলাকায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গুলি ছুঁড়তে থাকে। এতে মাদাম ব্রিজের ওপরেই সাদ আল আফনান নামে এক কলেজছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে মারা যান।
এরপর ছাত্র-জনতার ভয়ে পিছু হটে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ তাদের লোকজন। বিপুল সংখ্যক আওয়ামী কর্মীরা পালিয়ে গেলেও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাহ উদ্দিন টিপু লোকজন নিয়ে তমিজ মার্কেট এলাকার বাসার ছাদে অবস্থান নেন। তখন বাসার চারপাশে তার বিপুল সংখ্যক কর্মী ছিল। ওইদিনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায় একটি বড় ড্রামে পানিতে মরিচ মেশানো হচ্ছিল। এ ছাড়া হেলমেট মাথায় দিয়ে টিপু ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করছে। মরিচ মেশানো পানি ছাত্র-জনতার ওপর বর্ষণ করা হয়। তখন যুবলীগ-ছাত্রলীগের গুলিতে তমিজ মার্কেট এলাকায় ওসমান গণি, কাউসার হোসেন ও সাব্বির হোসেন রাসেল নামে তিন শিক্ষার্থী মারা যান। পরে হামলায় একই স্থানে যুবলীগ-ছাত্রলীগের আরও ৮ জন মারা গেছেন।
ওইদিন ছাত্রজনতার আন্দোলনে সুজনও ছিলেন। টিপুর বাসার সামনেই একটি গুলি তার পেটের ডান পাশে লেগে লিভারে গিয়ে আটকে যায়। এতে সঙ্গে সঙ্গেই সুজন অচেতন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া তার শরীরের বিভিন্ন অংশে ৯টি ছররা গুলি লাগে। এরমধ্যে একটি তার গলার ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাম পাশে ভেতরে আটকে গেছে। ওই গুলির কারণেই তার বাম পা ও বাম হাত প্যারালাইসড হয়ে আছে। এ ছাড়া আরও ৬টি ছররা গুলি তার দেহের ভেতরে রয়েছে। যেগুলো বের করতে হলে তাকে বিদেশে চিকিৎসা করাতে হবে। গুলিবিদ্ধ সুজনের পুরো শরীর এখন অকেজো বললেও চলে। ডান হাত দিয়ে হালকা ওজনের কিছু উঠানোর শক্তিও সঞ্চয় নেই তার শরীরে।
আরও পড়ুন
আহত খালেদ মাহমুদ সুজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুবলীগ নেতা টিপু সরাসরি গুলি করেছে। পেটে গুলি লাগার পরই আমি অচেতন হয়ে পড়ি। ১৮ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয় আমাকে। অপারেশন করে আমার লিভারে আটকে থাকা পিতলের গুলি বের করা হয়। হাত থেকে একটি গুলি বের করা হয়েছে। সিএমএইচ’র চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আমার শরীরের থাকা ৭টি ছররা গুলি তারা বের করতে পারবে না। বিদেশে চিকিৎসার মাধ্যমে তা বের করা যেতে পারে। দেশে বের করতে গেলে আমি মারা যেতে পারি। ৩০ দিন সিএমএইচে থাকার পর বাড়ি চলে আসি। ডান হাতে তিনটি, ঘাড়ে একটি, বুকের ভেতরে দুটি ও কানের নিচে একটি ছররা গুলি এখনো রয়ে গেছে। পুরো শরীরে তেমন কোনো শক্তি নেই। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন প্রায় ২ বছর লাগবে সুস্থ হতে। তবে স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারব না। ভারি কিছু বহনও করতে পারব না। আমার সংসারে উপার্জনক্ষম কেউ নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ পুরাই অন্ধকারে।
সুজনের চাচা কফিল উদ্দিন বলেন, সুজনদের অভাবের সংসার। তার বাবা-ভাই প্রতিবন্ধী। সুজনই ছোটবেলা থেকে সংসার চালিয়ে আসছে। কিন্তু এখন তার সে অবস্থা নেই। তার নিজের চিকিৎসা খরচও চালানোর মতো সাধ্য নেই। তার সুচিকিৎসা এবং পরিবারের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।
লক্ষ্মীপুরের অন্যতম ছাত্র সমন্বয়ক বায়োজীদ হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি করছি। এখন যাদের চিকিৎসা প্রয়োজন, সরকারকেই তা নিশ্চিত করতে হবে।
সদর হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক জয়নাল আবেদিন জানান, শরীরের ভেতরে গুলি থাকা খুব কষ্টদায়ক। সুজনের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিটি গুলি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এর কারণে শরীরে ইনফেকশন দেখা দিলে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। দেশে তার চিকিৎসা সম্ভব নয়।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের তালিকা করা হচ্ছে। আমরা তাদের পরিবারের পাশে আছি।
এমজেইউ