অস্তিত্ব সংকটে কুমিল্লার পুরাতন বা মরা গোমতী নদী। কুমিল্লা শহরের কাপ্তানবাজার থেকে শুভপুর এলাকা পর্যন্ত আঁকাবাঁকা প্রায় ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদী দখল আর দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। এ নদীর দুই তীরের জলাধার দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনসহ নানা স্থাপনা।

বিগত সময়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য প্রশাসন পদক্ষেপ নিলেও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের বাড়িঘর, শহরের ড্রেনের দূষিত ময়লা-আবর্জনা, অসংখ্য ঝুলন্ত পায়খানার মানববর্জ্য, কচুরিপানায় একাকার হয়ে নদীর পানি কালো-দুর্গন্ধময় ও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছেন মরা নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক সময় কুমিল্লা শহর ঘেঁষে প্রবাহমান ছিল গোমতী নদী। তখন বর্ষাকালে বন্যায় নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে বাঁধ ভেঙে শহর তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করতো। তাই শহর রক্ষার জন্য গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এ নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। এরপর থেকে শহরের উত্তর প্রান্তের কাপ্তানবাজার থেকে পূর্ব প্রান্তের শুভপুর এলাকা পর্যন্ত নদীর প্রায় ছয় কিলোমিটার অংশ ‘পুরাতন’ বা ‘মরা’ গোমতী নদী নামে পরিচিতি লাভ করে।

ষাটের দশকে মরা নদীর এপারের (শহরের) মানুষের সঙ্গে ওপারের যোগাযোগের জন্য কাপ্তানবাজার, পুরাতন চৌধুরীপাড়া, থানা রোড, হারুন স্কুল সড়ক ও চকবাজার এলাকায় পাঁচটি আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া হয়। এই নদীর কূলে রয়েছে কুমিল্লা নগরীর ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ড। সেসব এলাকার বাসিন্দাদের দুঃখ এই মরা গোমতী নদী।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, স্থানীয়দের অনেকে প্রভাব খাটিয়ে মরা নদীর বিভিন্নস্থানের দুই পাড় ও পানির অংশ ধীরে ধীরে অবৈধভাবে দখলে নিয়ে ভরাট করে বহুতল ভবন, আধাপাকা বাড়িঘর ও দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। এতে মরা নদীর দুই পাড়ে ঘনবসতি গড়ে ওঠেছে এবং দখলযজ্ঞে নদীটি সরু খালের আকার ধারণ করেছে।

বর্তমানে নদীর বেশিরভাগ অংশ কচুরিপানা ও আবর্জনায় ভরে আছে। মরা নদীর শুভপুরের বজলুর রশিদ, গাংচরের হেলাল উদ্দিন, কাপ্তানবাজারের বাসিন্দা জহিরুল ইসলামসহ নানা পেশার বাসিন্দারা জানান, এই নদীর পানিতে মরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কুকুর-বিড়াল, পশু-পাখি ছাড়াও কচুরিপানা, আবর্জনা ও নেশাজাতীয় মাদকদ্রব্যের বোতল ভাসতে দেখা যায়। এখন দূষিত কালো পানি থেকে বাজে গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভুগছেন নদীর দুই পাড়ের অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ।

আদর্শ সদর উপজেলা ভূমি অফিসের একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত পুরাতন গোমতী নদীর দুই পাড়ের ৭৭২ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়েছে। তাদের উচ্ছেদের জন্য বিগত ২১ বছরে কয়েক দফা নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে তৎকালীন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নদীর অবৈধ দখলীয় মোট ২৫৮ দশমিক শূন্য দুই একর জমি দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসকের নিকট তথ্য দিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু উচ্ছেদ হয়নি সেসব অবৈধ স্থাপনা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা শাখার সভাপতি ডা. মো. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই প্রাকৃতিক জলাধারটি দখল-দূষণে অনেকটা বিলীনের পথে। এর অস্তিত্বরক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সভা-সেমিনার ও নানা কর্মসূচি পালনসহ স্মারকলিপি দেওয়া হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। তবে নদীর জায়গা দখলমুক্ত করে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকার হাতিরঝিলের আদলে গড়ে তোলা গেলে এ মরা নদী কুমিল্লা নগরে পর্যটনের এক নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটাতে পারে এবং এটা হতে পারে নগরস্পন্ধন।

কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলম বলেন, পুরাতন গোমতী নদীসহ কুমিল্লা নগর এলাকার বহুমাত্রিক উন্নয়নের জন্য ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর একনেক সভায় দেড় হাজার কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। নদীর জায়গা দখলমুক্ত করে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে প্রাচীন এ শহরের সৌন্দর্য আরও বেড়ে যাবে, এজন্য কাজ চলছে।

কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, অবৈধ দখলদারদের তালিকা করা হয়েছে। আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। জেলা-পুলিশ প্রশাসনের সমন্বয়ে অভিযান পরিচালনা করে নদীর সম্পত্তি দখলমুক্ত করা হবে।

আরিফ আজগর/আরকে