মেয়ের সাফল্যে খুশির জোয়ারে ভাসছেন রূপনার মা
দুই বছর আগে ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো মেয়ের সাফ জয়ী হওয়ার খবর পান কালাসোনা চাকমা। ঠিক দুই বছর পর আবারও সেই একই খবরে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছেন পাহাড়ি গ্রামের ষাটোর্ধ্ব এই নারী। বলছি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক রূপনা চাকমার মায়ের কথা।
কালাসোনা চাকমার পাশাপাশি রাঙামাটির পাহাড়ের দুর্গম গ্রাম ভূঁইয়াে আদামের মানুষ দুই বছর আগে যে আনন্দে ভেসেছিল, সেই গ্রামে আবারও এলো একই খুশির বন্যা। খেটে-খাওয়া গ্রামের সহজ-সরল এসব মানুষের জীবনে আনন্দ বলতে তেমন কিছু না এলেও এক রূপনা চাকমার কৃতিত্বে দুই বছর পর আবারও একই উপলক্ষ্যে আনন্দে মেতেছেন এই গ্রামের মানুষ। তাদের গর্বের রত্ন রূপনা চাকমার দল দ্বিতীয়বার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। টুর্নামেন্টে সেরা গোলকিপার মনোনীত হয়েছে তাদের প্রিয় রূপনা।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের নারী দলের গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী রূপনা চাকমার বাড়ি রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ভূঁইয়ো আদাম নামে দুর্গম এক পাহাড়ি গ্রামে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে এগোতে ছড়ায় ভাগ হয়ে গেছে গ্রামের দুইটি অংশ। ছড়ার ওপর এলাকাবাসী উদ্যোগে একটি বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়েছে। নড়বড়ে এই সাঁকো দিয়েই তাদের নিত্যদিনের চলাচল। দুই বছর আগে এই গ্রামে এসে জেলা প্রশাসক ঘোষণা দিয়েছিল সেতু নির্মাণ করা হবে। সেই মতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে শুরু হয় সেতু নির্মাণের কাজ। ইতোমধ্যে সেটির পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে।
বাঁশের সাঁকো পার হয়ে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় রূপনা চাকমার বাড়ি। আগে জীর্ণ একটি কুটিরে তাদের বসবাস থাকলেও দুই বছর আগে গ্রামে এসে জেলা প্রশাসক বাড়িটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেমি পাকা এই বাড়িতে এখন থাকেন রূপনা চাকমার মা কালাসোনা চাকমা। এখনো তিনি ঘরের সামনে একটি জমিতে চাষবাস করেন। হেমন্তের এই সকালে শীতকালীন সবজি চারা পরিচর্যায় ব্যস্ত দেখা যায় রূপনার মা কালাসোনাকে।
মেয়ের কৃতিত্বের কথা জিজ্ঞেস করতেই কালাসোনা চাকমা হেসে জানান, মেয়ের এমন অর্জনে তিনি খুব খুশি। মেয়েকে অনেক বেশি আশীর্বাদ করলেন, যাতে সে আরও এগিয়ে যেতে পারে। গতকাল (বুধবার) রাতে মোবাইলে মেয়ের খেলা দেখেছেন তিনি। পরপর দুইবার রূপনা সেরা নির্বাচিত হওয়ায় খুশি কালাসোনা চাকমা।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই বছর আগে জেলা প্রশাসক এই বাড়িটি করে দিয়েছিলেন। তবে পানির সমস্যা এখনো সমাধান হয়নি। এ জন্য ঘরের ভেতরের বাথরুম এখনো ব্যবহার করতে পারি না। এছাড়া ঘরের পাশে ছাদ করে না দেওয়ায় বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে।
দুই বছর আগে সরকারের তরফ থেকে দেওয়া রূপনা চাকমার সেমি পাকা ঘরে ঢুকতেই শো-কেসে দেখা গেল বিভিন্ন সময়ে রূপনা চাকমার কৃতিত্বের স্মারক। শো-কেস ভর্তি নানান ট্রফি, ক্রেস্টে। সঙ্গে আছে অনেক ছবিও।
রূপনা চাকমার ভাবী সুশীলা চাকমা বলেন, খুব ভালো লাগছে সে (রূপনা) আবারো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং পরপর দুইবার সেরা গোলকিপার নির্বাচিত হয়েছে।
তাকে করে দেওয়া ঘরের বিষয়ে তিনি বলেন, গতবার রূপনাকে একটি ঘর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘরের পাশে ছাদ না দেওয়ায় বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে। ছাদের নিচে বেড়া না থাকায় শীতকালে কুয়াশায় টিন ঘেমে বৃষ্টির মতো ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে। গরমকালে বেশি গরম লাগে। পানিরও সমস্যা আছে। সেতুর কাজ শেষ হলেই যাতে রাস্তার কাজ করা হয় সেই দাবি জানান সুশীলা।
স্থানীয়রা জানান, বিধবা মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান রূপনা চাকমা। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি মনোযোগী তিনি। তবে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে মা ও ভাই বোনকে ছেড়ে। ছোটবেলায় খেলাধুলা ও পড়ালেখার জন্য কাউখালী উপজেলার ঘাগড়ায় চলে যান রূপনা। তার বাবা নেই। ফলে তার লড়াই ছিল আরও কঠিন। এখন রূপনার এমন অর্জনে গ্রামের মানুষ অনেক বেশি খুশি। তার কারণে দেশের মানুষ এখন দুর্গম এই গ্রামটিকে চিনতে পারছে। সরকার তাদের গ্রামের খবরাখবর রাখছে, সেতু হচ্ছে। সামনে যেন রাস্তা হয় সেই দাবি জানান তারা।
আরও পড়ুন
গ্রামের দোকানদার স্বপ্না চাকমা বলেন, রূপনার কৃতিত্বে আমরা গ্রামবাসী অনেক খুশি। সে আবারো আমাদের গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করল। আমরা তাকে বরণে উন্মুখ হয়ে আছি।
তিনি আরও বলেন, গতবার তার এমন সফলতায় জেলা প্রশাসক এসে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবার যেন রাস্তাটি করা হয় সেই দাবি জানাচ্ছি।
ওয়ার্ড মেম্বার অনল বিজয় চাকমা বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখতাম রূপনা ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকতেন। যেখানে সুযোগ পেতেন সেখানেই খেলতেন। এই মেয়ে আমাদের গর্ব। পরপর দুইবার সেরা গোলকিপার হয়েছেন। তার কারণে এলাকার সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি রূপনাসহ তার টিমের সব সদস্যকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
ঘিলাইছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অমল কান্তি চাকমা বলেন, আগেও রূপনা আমাদের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে, এবারও আনল। তাকে সুন্দরভাবে বরণে আমরা পরিকল্পনা করছি।
মিশু মল্লিক/এফআরএস