চাহিদা অনুযায়ী আলুবীজ পাচ্ছেন না রংপুর অঞ্চলের কৃষকরা
দেশে আলু উৎপাদনে রংপুর অঞ্চল এগিয়ে থাকলেও পিছিয়েছে চাহিদা অনুযায়ী আলুবীজ বরাদ্দ পাওয়া থেকে। প্রতিবছর আলুর উৎপাদন বাড়লেও রংপুর অঞ্চলে আলুবীজের বরাদ্দ কমাচ্ছে সরকারি বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও গত ছয় বছরে আলুবীজের বরাদ্দ কমেছে প্রায় ১ হাজার ৪২৮ দশমিক ৭৫৯ টন।
এ অঞ্চলের রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলায় এ সময়ে আলু চাষের জমি বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার ২০২ হেক্টর। আলুবীজের বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য বিএডিসির বীজ বিপণনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে কৃষক ও ডিলাররা।
বিজ্ঞাপন
বিএডিসি রংপুর অঞ্চলের (বীজ বিপণন) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বিতরণ বর্ষে আলুবীজের মোট বরাদ্দ ২ হাজার ৭৯৭ দশমিক ৩২ টন। এর মধ্যে নিবন্ধিত ডিলারদের জন্য বরাদ্দ ২ হাজার ২৬১ দশমিক ৬০০ টন, আগাম আলু চাষের জন্য ২৮২ দশমিক ৫৬০ এবং কৃষক ও বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ২৫২ দশমিক ৮৭২ টন।
এ বছর রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ২ হাজার ২৬১ দশমিক ৬০০ টন বীজ ৮১৮ জন নিবন্ধিত ডিলারের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রংপুর জেলায় বিতরণ করা হচ্ছে ৬৭৭ দশমিক ৬০০ টন, গাইবান্ধায় ৪৪০ দশমিক ৮৮০, লালমনিরহাটে ৩৪৩ দশমিক ২০০, নীলফামারীতে ৪০৩ দশমিক ৯২০ ও কুড়িগ্রামে ৩৯৬ টন। শর্তানুযায়ী আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে আগাম আলুবীজ প্রত্যেক ডিলারের জন্য বরাদ্দ এক টন। এছাড়া রংপুরের প্রত্যেক ডিলারের বরাদ্দ দুই ধাপে যথাক্রমে ১ দশমিক ৬৮০ ও ১ দশমিক ৪০০ টন। অন্য জেলাগুলোর ডিলারদের বরাদ্দ দুই ধাপে যথাক্রমে ১ দশমিক ৪৮০ ও ১ দশমিক ১৬০ টন। এখন পর্যন্ত ৭৫৯ জন ডিলারের নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে। গত ছয় বছরে আলুবীজের বরাদ্দ কমেছে প্রায় ১ হাজার ৪২৮ দশমিক ৭৫৯ টন। ২০১৮-১৯ বিতরণ বর্ষে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৭২৭ দশমিক ৪৬৩ টন।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে (২০২৪-২০২৫) রংপুর অঞ্চলে আলু আবাদ শুরু হয়েছে। গত ২০২৩-২০২৪ মৌসুমে ১ লাখ ৬০৩ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছিল। এবার চাষের জমি আরও বাড়বে। চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় আলুবীজের সম্ভাব্য চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার টন।
১১টি আলুর জাত হচ্ছে বিএডিসি আলু-১ (সানসাইন), বিএডিসি আলু-৩ (সান্তানা), বারি আলু-১৩ (গ্র্যানুলা), বারি আলু-২৯ (কারেজ), বারি আলু-৮৫ (৭ ফোর ৭), বারি আলু-২৫ (এস্টারিক্স), বারি আলু-৯০ (অ্যালুইটি), বিএডিসি আলু-২ (প্রাডা), বিএডিসি আলু-৮ (ল্যাবেলা), বিয়ান্না ও কিং রাসেট।
বিএডিসির আলুবীজ মানসম্পন্ন। তাই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বীজের চেয়ে এর চাহিদা সবসময় বেশি। কিন্তু দীর্ঘদিনেও বীজ উৎপাদন না বেড়ে বরং প্রতি বছর কমছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরামের আহ্বায়ক এস এম পিয়াল বলেন, অনেক কৃষক নিজ উদ্যোগে বীজ আলু সংরক্ষণ করেন। এছাড়া প্রতিবছর বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিও আলুবীজ বাজারে আনে। তাই সুষ্ঠু নীতিমালা করে বিএডিসি নিজেদের বীজের মান ধরে রাখলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বিরাহীম আইএপিপি কৃষক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোকছেদুল ইসলাম জানান, সারা বাংলা কৃষক সোসাইটির অর্থায়নে ২০১২ সালে তাদের সমিতির কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে ২৫ জন সদস্য ছিলেন। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ১৪৫। প্রতি বছর প্রায় ২০০ একর জমিতে আলু চাষ করেন। তাদের উৎপাদিত আলু এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রফতানিও হচ্ছে। ২০১৯ সালে তাদের স্বর্ণসময় ছিল। ওই সময় প্রায় দুই হাজার টন আলু রফতানি হয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম অন্যতম। কিন্তু মানসম্মত ও কাঙ্ক্ষিত বীজ না পাওয়ায় তারা চাহিদা মতো আলু রফতানি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
এই কৃষক বলেন, প্রতি একরে বীজের প্রয়োজন প্রায় ৮০০ কেজি। জমিতে সব সময় বিএডিসির আলুবীজ ব্যবহার করি। কিন্তু রংপুর অঞ্চলে বিএডিসির বরাদ্দ কম থাকায় প্রয়োজনীয় বীজ সহজে পাচ্ছি না আমরা।
বিএডিসির কয়েকজন ডিলারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলে অনেক আগে থেকে আলুর ব্যাপক আবাদ হয়। এমনকি কোনো কোনো জমিতে একবার আলু উত্তোলন করে পুনরায় আলু আবাদ হয়। এছাড়া কয়েক বছর ধরে আলুর ভালো দাম পাওয়ায় নতুন কৃষকরা আলু আবাদে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। তাই এবার বিএডিসির আলুবীজের ভালো চাহিদা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ অঞ্চলে বীজের বরাদ্দ প্রত্যাশিত নয়। তাই অনেক কৃষক মানসম্পন্ন বীজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে যেমন-তেমন বীজ বপন করে সর্বস্বান্ত হতে পারেন। আলুবীজ এ গ্রেডের এস্টারিক্স প্রতি কেজি ৬৬ টাকা এবং অন্যান্য জাত ৬৪ টাকা। বি গ্রেড প্রতি কেজি ৬৩ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি বড় সাইজের আলু ৬০ টাকা বলেও জানান তারা।
এদিকে বীজ বরাদ্দ কম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএডিসি (বীজ বিপণন) রংপুর অঞ্চলের উপপরিচালক মো. মাসুদ সুলতান বলেন, আলুবীজের বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে ঢাকা অফিসে। আমরা শুধু তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছি। তবে আমরা প্রায় ৩ হাজার ২০০ টন বীজের চাহিদার জন্য আবেদন করেছিলাম। চলতি বছর ডিলার, কৃষকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএডিসির আলুবীজের ভালো চাহিদা রয়েছে।
বরাদ্দ কম হওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, বেশ কিছু বিষয় পর্যালোচনা করে বীজ বরাদ্দ হয়। এর মধ্যে গত বছরের বীজ বিক্রির গতিধারা আমলে নেওয়া হয়। গতবার বীজের দাম বেশি ছিল বলে জানিয়েছিলেন ডিলাররা।
এদিকে আগাম আলুবীজ বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া উপযুক্ত ও সাধারণ মৌসুমের আলুবীজ উত্তোলন ও বিতরণ দুটি ধাপে সম্পন্ন হওয়ার চূড়ান্ত সময় হচ্ছে আগামী ১ নভেম্বর।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর