কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে এতিমখানার নামে সরকারি জমি দখল, ১৫০ জনকে দাফন করা কবরস্থান দখল এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।

অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান জেলার বুড়িচং উপজেলার পীরযাত্রাপুর মধ্যমপাড়া এলাকার মৃত মহব্বত আলীর ছেলে। তিনি সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুর ঘনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। আব্দুল মতিন খসরুর অনুগ্রহে ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পিপি হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজ এলাকা বুড়িচংয়ের পীরযাত্রাপুর এলাকায় মধ্যমপাড়া আবির মান্দারবাড়ির পাশে ২০১৩ সালে উত্তর যাত্রাপুর মৌজার ৬৩৯ হালদাগ এবং সাবেক ৪১৪ দাগের ১৫ শতক পৈতৃক সম্পত্তি মাদরাসা ও এতিমখানার নামে ৫২৭১ নম্বর দলিলে ওয়াকফ করেন সাবেক পিপি মুজিবুর রহমান, তার ভাই আজিজুর রহমান, আতিকুর রহমান, বোন ইয়াসমিন, নাজমা বেগম এবং মা মানিকজান বিবি।

ওয়াকফকৃত ওই জমিতে মাদরাসা ও এতিমখানা করার কথা থাকলেও সাবেক পিপি মুজিবুর রহমান প্রভাব খাটিয়ে কৌশলে এতিমখানাটি সেখানে না করে পীরযাত্রাপুর মধ্যমপাড়া আবীর মান্দারবাড়ি পারিবারিক কবরস্থানের ওপর নির্মাণ করেন।

স্থানীয়রা জানান, ওই এলাকার প্রায় ৪০টি পরিবারের অন্তত ১৫০ জন মানুষকে দাফন করা ওই কবরস্থানের ওপর মাদরাসা ও এতিমখানাটি নির্মাণ করতে বাধা দিলেও প্রভাব খাটিয়ে সেখানেই নির্মাণ করেন মুজিবুর রহমান। শতবর্ষী ওই কবরস্থানে এতিমখানা নির্মাণে স্থানীয়রা বাধা দিলেও তাতে কোনো কর্ণপাত করেননি। যারাই বাধা দিতে এসেছেন কিংবা প্রতিবাদ করেছেন সবার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন সাবেক এই পিপি।

পূর্বপুরুষদের শায়িত করা ওই কবরস্থান পুনরুদ্ধার চেয়ে গতকাল রোববার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে ওই এলাকায় মানববন্ধন করেন স্থানীয়রা। মানববন্ধনে ৯০ বছর বয়সী রমিজ উদ্দিন বলেন, এখানে আমার মা, বাবা এবং ভাইদের কবর। মুজিবুর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেটি দখল করেছেন। আমি আমার বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করতে পারি না।

স্থানীয় জয়নাল আবেদিন বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি কেউ মারা গেলে এখানে দাফন করতে। এখানে আমার আপন ভাইয়ের কবর রয়েছে। মুজিবুর রহমান সেটি দখল করে মাদরাসা তৈরি করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে কবরস্থানের ওপর মাদরাসাটি নির্মাণ করা হয়েছে সেটি মূলত সরকারি খাস জমি। উত্তর যাত্রাপুর মৌজার ১ নম্বর খতিয়ানের সাবেক ৩৫৭ এবং হালদাগ ৮৯৯ এর ২৩ শতক সরকারি খাস জমি দখল করে মাদরাসা ও এতিমখানা নির্মাণ করেন মুজিবুর রহমান। কবরস্থানটি যে সরকারি খাস জমির ওপর সেটি স্থানীয় লোকজন না জানলেও ঠিকই জানতেন মুজিবুর। কৌশলে সেটি সরকারি জায়গার ওপর নির্মাণ করে নিজের বাবার নামে নামকরণ করে তিনি এলাকায় নিজেকে মহামানব হিসেবে পরিচিত করতে এমনটা করেছেন বলে দাবি স্থানীয়দের।

মাদরাসা ও এতিমখানার জমিটি সরকারি জমি বলে ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন পীরযাত্রাপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, বিএস খতিয়ানের ৮৯৯  এবং আরএস খতিয়ানের ৩৫৭ নম্বর দাগের জমিটি সরকারি জমি। সেই জমিটির এখনও মালিক জেলা প্রশাসক মহোদয়। সেটি কাউকে হস্তান্তর করা হয়নি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিজেদের ওয়াকফকৃত জমিটি ভোগ-দখল করতে নিজের প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই সরকারি জমি দখল করে তাতে মাদরাসা ও এতিমখানা করেন মুজিবুর রহমান। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ওয়াকফকৃত জমিটিতে প্রচুর বড় বড় কচুরিপানা ভরে আছে। সেটি এখনো মুজিবুর রহমানদের দখলে রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চালু করা হয় এতিমখানাটি। সেটির নামকরণ নিজের বাবার নামে করেন মুজিবুর রহমান। ‘পীর মহব্বত আলী দারুল ইসলাম হাফিজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা’ নাম দেন। স্থানীয়দের আর্থিক সহায়তায় সেটি নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। চার তলা ফাউন্ডেশনের এক তলা দালানটি নির্মাণে ওই এলাকার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আবুল কাসেম সকল নির্মাণসামগ্রী দেন ব্যক্তিগত তহবিল থেকে। এছাড়াও এলাকার লোকজন স্থানীয়ভাবে চাঁদা তুলে সেটির কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু সাবেক পিপি মুজিবুর রহমান নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে সরকারি বিভিন্ন অনুদান এনে সেসব আত্মসাৎ করেন। ২০১৪ সালে চালুর পর থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ক্যাপিটেশনগ্রান্টের আওতায় নিয়ে আসেন ওই মাদরাসা ও এতিমখানাটি। পরবর্তীতে ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার বিভাগের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (টিআর) প্রতিটি অর্থবছরে এতিমখানাটির বিভিন্ন খাত দেখিয়ে বরাদ্দ এনে সেগুলো আত্মসাৎ করেন তিনি।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের টিআর প্রকল্পের বরাদ্দের একটি তালিকা এসেছে ঢাকা পোস্টের কাছে। সেই তালিকায় বিভিন্ন খাত দেখিয়ে ২২টি বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়। যার অর্থের পরিমাণ ৬০ লাখ ২১ হাজার ৫৯৮ টাকা। তবে চাহিদার সবগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন বুড়িচং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আহসান মুরাদ।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে টিআর প্রকল্পে যেসব বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে সেসবের সবগুলো অনুমোদন হয়নি। যেসব প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেগুলোর পুরোপুরি কাজ করা হয়েছে। 

এছাড়াও সাবেক পিপি মুজিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে,  এতিম আছে তিনজন। কাগজে কলমে ৪২ জন অনাথ শিশুর নাম থাকলেও বাস্তবে সেখানে ১০-১২ জন শিশুকে পাওয়া গেছে। তিনজন ছাড়া তাদের কেউ কেউ মধ্যবিত্ত, কেউ নিম্ন মধ্যবিত্ত আবার কেউ নিম্নবিত্ত পরিবারের। তবে একেবারেই অনাথ কিংবা সুবিধাবঞ্চিত একজন শিশুকেও পাওয়া যায়নি। সেসব শিশুর মধ্যে এক জনের মা নেই, বাবা আছে। একজনের বাবা নেই, কিন্তু মা আছেন। হাফেজিয়া শাখায় পড়াশোনা করা সেসব শিশুদের অভিভাবকদের কাছ থেকে মাসিক বেতন নিচ্ছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে অবস্থা ভেদে বেতনও ভিন্ন। ৪২ শিশুর মধ্যে কারও কাছ থেকে মাসিক ৫০০ টাকা, কারও কাছ থেকে ১ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা করেও মাসিক বেতন নেওয়া হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক পিপি মুজিবুর রহমান ২০১৪ সালে মাদরাসাটি চালু করার পর থেকেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের বেসরকারি এতিমখানার এতিম শিশুদের জন্য ক্যাপিটেশন গ্রান্ট বরাদ্দ ও মঞ্জুরিতে তালিকাবদ্ধ করান এতিমখানাটি।  প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতি বছর সমাজসেবা অধিদপ্তর দুই কিস্তিতে সেই বরাদ্দের টাকা পরিশোধ করে আসছে। প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই কিস্তিতে অর্থ দেওয়া হয়। প্রতি কিস্তিতে ৩ লাখ ৬০ হাজার করে টাকা করে দুই কিস্তিতে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা প্রতি বছর পেয়ে আসছে মুজিবুর রহমানের মাদরাসা ও এতিমখানাটি।

 ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ৭২ লাখ টাকা সরকারিভাবে এতিম শিশুদের খাওয়া বাবদ দেওয়া হয়েছে এতিমখানাটিতে। কিন্তু শুধুমাত্র নামেই এতিমখানাটিতে কোনো এতিম না থাকা এবং পড়ুয়া ছাত্রদের কাছ থেকে মাসিক বেতন নেওয়ার পরেও মিথ্যা তথ্য আর সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরকে ম্যানেজ করে আনা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের ক্যাপিটেশন গ্রান্টের লাখ লাখ টাকা গেল কোথায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।

শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মাদরাসা ও এতিমখানাটির সভাপতি হিসেবে আসীন রয়েছেন সাবেক পিপি মুজিবুর রহমান। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজের ভাই আজিজুর রহমানকে রেখেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন মুজিবুর রহমান।

শাহ আলম খান নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুজিবুর রহমান সাহেব অনেক প্রভাবশালী। তিনি একে তো অনিয়ম করে নিজেদের ওয়াকফকৃত জমি বাদ রেখে সরকারি জমি দখল করে কবরস্থানের ওপর মাদরাসাটি নির্মাণ করেছেন,  দ্বিতীয়ত সেখানে একজন এতিমও নেই। এখানে ২২-২৩ জন ছাত্র হাফেজি পড়ছে। সবার কাছ থেকে বেতন নেওয়া হচ্ছে প্রতি মাসে। শুরু থেকেই উনার ইনটেন্স ভালো ছিল না। কেউ প্রতিবাদ করলে তার রোষানলে পড়তে হত দেখে কেউ ভয়ে আর মুখ খুলত না। সরকার পতনের পর থেকে তিনি এখন এলাকায় আর আসেন না।

এসব বিষয় উল্লেখ করে গত বছরের ১৮ জানুয়ারি স্থানীয় শাহ আলম খান নামে এক বাসিন্দা কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিলেও সে অভিযোগের ন্যূনতম তদন্ত হতেও দেননি মুজিবুর রহমান। তৎকালীন জেলা প্রশাসক খন্দকার মুশফিকুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে সেই অফিসেই সেই লিখিত অভিযোগ মাটিচাপা দেন সাবেক এই পিপি।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত কুমিল্লার সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমানের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বুড়িচং উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কবির আহমেদ বলেন, আমি ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় কর্মরত আছি। গত মে মাসে বুড়িচং উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়েছি। এতিমখানাটি কীভাবে সরকারি ক্যাপিটাল গ্রান্টের আওতাধীন এলো, সরকারি বরাদ্দ এবং এতিম শিশু আছে কি না বিষয়গুলো সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। কোনো অসঙ্গতি পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বুড়িচং উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তারের মোবাইলে কল করা হলে উপজেলার সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) সোনিয়া হক রিসিভ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউএনও স্যার ছুটিতে দেশের বাইরে আছেন। আমি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আপনি যে বিষয়গুলো বললেন সেগুলো নিয়ে ইউএনও স্যার দেশে এলে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের কুমিল্লার উপপরিচালক জেডএম মিজানুর রহমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি এখনই আপনার (প্রতিবেদকের) মাধ্যমে জানলাম। খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়সার ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানকে ক্যাপিটেশন গ্রান্টের আওতায় আসতে হলে তার ন্যূনতম রেজিস্ট্রেশন থাকা লাগে। কিন্তু সরকারি জমি দখল করে কোনো প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই। সার্বিক বিষয়গুলোর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 

আরএআর