৫ তলা ভবনের মালিক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন
গাইবান্ধায় তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী মিজানুর রহমান সবুজ অল্প সময়ে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তাকে নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কৌতূহল দেখা দিয়েছে। তার আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। সবুজ বর্তমানে গাইবান্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ল্যাব সহকারী হিসেবে কর্মরত। আগে তিনি রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন।
জানা গেছে, গাইবান্ধা জেলা শহরের থানাপাড়ায় সবুজের আধুনিক পাঁচ তলা ভবন রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা। এই ভবনের ডিজাইন এবং স্থাপত্যশৈলী এলাকাবাসীর নজর কেড়েছে। তবে ভবনটি নির্মাণে গাইবান্ধা পৌরসভার তিন তলা পর্যন্ত অনুমতি থাকলেও নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচ তলা। গাইবান্ধা পৌরসভা ভবনটির নকশা বহির্ভূত অংশ অপসারণে ১১ মাস আগে নোটিশ দিলেও কোনো তোয়াক্কা করেননি ভবনের মালিক।
বিজ্ঞাপন
মিজানুর রহমান সবুজ সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ভাঙ্গা ডিপ বাজার এলাকার মৃত আমিনুল ইসলামের ছেলে। তার বাবা পেশায় ব্যাংকের কর্মচারী ছিলেন। তিনি ১৯৯৫ সালে মারা যান। তখন সবুজের বয়স ছিল দুই বছর।
সূত্র জানায়, শুধু শহরে নয়, সবুজের গ্রামেও রয়েছে একতলা ভবন। তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী চাকরিজীবনের মাত্র তিন বছরে গাইবান্ধা জেলা শহরে ৫ শতাংশ জায়গা কিনে সেখানে পাঁচ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন- এটা এখন জেলার টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন সবুজ। চার বছর আগেও দাঁতের চিকিৎসা দেওয়া এই সবুজ দ্রুত বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ায় রীতিমতো আশ্চর্য তার স্বজন ও প্রতিবেশীরাও।
স্থানীয়রা বলছেন, কয়েক বছর আগেও সবুজ ছিলেন একজন সাধারণ ডেন্টাল কেয়ারের মালিক। এরপর ইলেকট্রনিক্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু গত চার বছরে হঠাৎ করে তার এত বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে যাওয়া অনেককে বিস্মিত করেছে। সাধারণ চাকরিজীবী হিসেবে তিনি ১৬তম গ্রেডের কর্মচারী। যার মাসিক বেতন স্কেল ৯৩০০ টাকা। তার পক্ষে এতো বিপুল সম্পদ অর্জন করা কীভাবে সম্ভব- এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।
নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সবুজের এক স্বজন জানান, ১৯৯৫ সালে সবুজের বয়স যখন দুই বছর ওই সময়ে তার বাবা আমিনুল মারা যান। সবুজরা তিন ভাই এক বোন। সবুজের দুই বড় ভাই টিভির মেকার। কল মেকার হিসেবেই তাদেরকে স্থানীয়রা ভালো চেনেন। অর্থাৎ বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা টিভি মেরামত করেন। ওয়ারিশ সূত্রে সবুজরা প্রত্যেকেই আড়াই বিঘার মতো করে জমি পেয়েছেন। যার বসতভিটা ছাড়া সবই বিক্রি করেন সবুজ। তবে যা বিক্রি করেছেন পরে ফুফুর জমিসহ ক্রয়ও করেছেন সমপরিমাণ জমি।
স্থানীয় রিয়াদ আদনান এক যুবক জানান, ৪ বছর আগেও দেখেছি সবুজ স্থানীয় বালুয়া বাজারে একটি ডেন্টাল কেয়ার দিয়ে সেখানে দাঁতের চিকিৎসা করতেন। হঠাৎ কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়ায় মাটিতে যেন পা পড়েনা সবুজের। তার চলাফেরা দেখে রীতিমতো হতভম্ভ তার স্বজন ও স্থানীয়রা। আমার মত অন্যদেরও প্রশ্ন- কী করে এত দ্রুত কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেলেন মিজানুর রহমান সবুজ।
স্থানীয় একটি সূত্রে বলছে, সবুজ স্থানীয় একটি ডিভাইস সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। সরকারি চাকরিতে পরীক্ষার্থীদের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সহায়তা করেন এবং এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। এই সিন্ডিকেটে তার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা খাতুনেরও নাম এসেছে। তিনি একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনিও সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। আঞ্জুয়ারাও গত দুই মাস পূর্বে বাদিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পৌর এলাকার পশ্চিম গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেপুটিশনে এসেছেন। মূলত এই ডিভাইস সিন্ডিকেটের কারণে তারা দুজনেই শহরে সংযুক্তি নিয়ে এসেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই সিন্ডিকেটকে সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্টরাও সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন
মিজানুর রহমানের বড় ভাইয়ের স্ত্রী শিউলি বেগম বলেন, সবুজ বউ নিয়ে শহরের বাড়িতে থাকে, গ্রামে কম আসে।
চাকরি নিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবুজ আগে মানুষকে চাকরি নিয়ে দিত। কিন্তু এখন আর ওগলা (ওইসব) করে না, বাদ দিছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাঙ্গা ডিপ বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, নিজ এলাকাসহ আশপাশের এলাকার বহুজনকে চাকরি দিয়েছেন সবুজ। একেকটি চাকরি দিতে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত নেন তিনি।
হঠাৎ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া এবং আয়ের উৎস সম্পর্কে জানতে চেয়ে মিজানুর রহমানের শহরের বাড়িতে গেলে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি তিনি। পরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডিভাইস সিন্ডিকেটের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
সবুজ জানান, তার দুই বউ একজন প্রাইমারিতে এবং আরেকজন স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে সরকারি চাকরি করেন। তিনি নিজেও একজন সরকারি চাকরিজীবী।
তিনি বলেন, আমার নিজের নামে ৬০ লাখ টাকা, এক স্ত্রীর নামে ১০ লাখ এবং আরেক স্ত্রীর নামে ১৩ লাখ টাকাসহ প্রায় ১ কোটি টাকার মতো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি করেছি। এছাড়া গ্রামের জমি বিক্রি করেছি। আমার ব্যবসাও আছে। আমার কোনো অবৈধ উপার্জন নেই। যদি মানুষ অভিযোগ করে থাকে তাহলে সেসব মিথ্যা।
এসব বিষয়ে গাইবান্ধা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার নূর মো. আনোয়ার রশিদ বলেন, মিজানুর রহমান সবুজ ১৬তম গ্রেডের একজন কর্মচারী। তার বেসিক বেতন স্কেল মাত্র ৯৩০০ টাকা। সম্প্রতি সবুজ এখানে সংযুক্তিতে এসেছেন। তার বিপুল সম্পত্তি এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের জানা নেই।
গাইবান্ধা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিও) মো. নবেজ উদ্দিন সরকার বলেন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সুপারিশের ভিত্তিতে সহকারি শিক্ষক আঞ্জুয়ারাকে শহরের স্কুলে সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গাইবান্ধা পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (ডিডিএলজি) শরিফুল ইসলাম বলেন, পৌরসভা আইনের তোয়াক্কা না করে ওই ভবন মালিক অবৈধভাবে পাঁচ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন, যা বেআইনি এবং গুরুতর অপরাধ। বাড়িটির অনুমোদন বহির্ভূত অংশ অপসারণে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, তা করা হয়নি। বেআইনি ভবন নির্মাণের বিষয়ে বিধি মোতাবেক দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রিপন আকন্দ/আরএআর