নিহত রেজাউল করিম (বামে), এসআই মো. মহিউদ্দিন

পুলিশের নির্যাতনে রেজাউল করিম (৩০) নামে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় এসআই মো. মহিউদ্দিনের বাসভবন ভাঙচুর করেছে স্থানীয়রা। রোববার (৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যার পর স্থানীয় জনতা নগরীর সাগরদী শেরে বাংলা সড়কের ভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে ভবনের একপাশের জানালার গ্লাস ভেঙে যায়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এদিকে, রোববার বিকেল সোয়া ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত সাগরদী হামিদ খান সড়ক ও রুপাতলী হাউজিংয়ের শেরে বাংলা সড়কে ওই যুবকের লাশ নিয়ে অবরোধ, বিক্ষোভ করেছে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। 

বরিশাল আইনজীবী সমিতির শিক্ষানবিশ আইনজীবী রেজাউল করিম রেজা ‘হত্যা’র ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান। তিনি বলেন, বিএমপির দক্ষিণ জোনের উপকমিশনার মো. মোকতার হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের ওই কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে তার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান এই শীর্ষ কর্মকর্তা। 

যদিও মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে ই-মেইল পাঠিয়ে দাবি করা হয়েছে, রেজাউল করিম পুলিশি নির্যাতনে মারা যাননি। তবে রেজার মৃত্যুকে ‘নির্যাতনে হত্যা’ অভিযোগ এনে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী মারুফা বেগম। 

বিষয়টি নিয়ে রেজাউল করিম রেজার সিনিয়র আইনজীবী জাকির হোসেন মিন্টু বলেন, আমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কখনো মনে হয়নি রেজাউল মাদক ব্যসায়ী। ছেলেটি অত্যাধিক মেধাবী ছিল। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করেন এই আইনজীবী।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত :

মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের হামিদ খান সড়কের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ইউনুচ মিয়ার ছেলে রেজাউলকে সাগরদী আব্দুল হামিদ খান সড়কের মুখে আটক করেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্ক এসআই) মহিউদ্দিন মাহি। ঘটনাটি লক্ষ্য করেন রেজাউল করিমের বাবা ও স্থানীয়রা। 

তার বাবা ইউনুচ মিয়া বলেন, আটকের পর আমার ছেলের কাছে বারবার দুইজন মাদক ব্যবসায়ীর নাম জানতে চাইছিল মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন আগে থেকেই আমাদের পরিচিত। তিনি ও আমরা একই এলাকার। বিষয়টি আমি জানতে চাইলে মহিউদ্দিন আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে সরিয়ে দেন। তখন আমি বলেছি, আমার ছেলে যদি মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে সবার সামনে তাকে তল্লাশি করা হোক। যদি মাদক পান তাহলে তাকে নিয়ে যাবেন। তখন এসআই মহিউদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সবার সামনে থেকে রাস্তার বিপরীত পাশে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরের ভেতর তল্লাশি চালায়। পরে আমাদের দেখায় রেজাউলের কাছ থেকে একটি ইনজেকশন ও সিরিঞ্জ পেয়েছে।

ইউনুচ মিয়া আরও বলেন, একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় উভয়ের মধ্যে তর্ক হচ্ছিল। তখন এসআই মহিউদ্দিন বারবার রেজাউলকে বলছিল, মাসের শুরুতে আমার দুটি মামলা দিতে হবে। তুই (রেজা) দুইজনের নাম দিলে আমি মামলা দিতে পারব। নাহলে তোকেই তুলে নিয়ে যাব। 

এ সময় রেজা বলছিল, আমিতো মাদক ব্যবসা করি না। ব্যবসায়ীর নাম পাব কিভাবে। এর আগেও আপনি (এসআই মহিউদ্দিন) আমাকে আটক করেছেন। কিছুইতো পান নাই। শুধু শুধু হয়রানি করেছেন। আপনি বললে আমি বরিশাল ছেড়ে চলে যাব। এর উত্তরে মহিউদ্দিন বলেন, ‘তুই কি এলাকার নেতা হইয়া গেছ?’ কথাবার্তাতো বলতাছ উল্টাপাল্টা। শেষে মহিউদ্দিনের গাড়িতে টেনে তুলে নিয়ে যায় রেজাউলকে। পরে শুনি ১৩৬ গ্রাম গাঁজা ও ৪ অ্যাম্পুল নেশাজাতীয় ইনজেকশন পাওয়ায় রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে।

নিহতের ফুপা তারেক মিয়া বলেন, রেজাউলকে হামিদ খান সড়কের একটি চায়ের দোকানের সামনে থেকে রাত ৮টার দিকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মহিউদ্দিন মাহি তুলে নিয়ে যায়। আমরা কারণ জানতে চাইলে মহিউদ্দিন কিছু জানায়নি।

এরপর শুক্রবার (১ জানুয়ারি) রাত পৌনে ১২টার দিকে কারা কর্তৃপক্ষ থেকে ইউনুচ মিয়াকে মুঠোফোনে জানানো হয় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রেজাউল। কারা কর্তৃপক্ষ ওইদিন রাত ৯টার দিকে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন বলে জানান বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক। 

তিনি বলেন, অসুস্থ অবস্থায় হাজতিকে কারাগারে আনা হয়। ফরওয়াডিং কাগজেও লেখা ছিল রেজাউল করিম অসুস্থ। তার দুই পা থেকে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাকে বুধবার (৩০ ডিসেম্বর) কারা কতৃপক্ষ রিসিভ করে। পরের দিন তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

খবর পেয়ে রেজাউলের ছোট ভাই আজিজুল করিম ও স্ত্রী মারুফা বেগম ছুটে যান হাসপাতালে। আজিজুল করিম বলেন, আমরা গিয়ে দেখি ভাইয়া নিস্তেজ হয়ে হাসপাতালের বেডে পড়ে আছেন। 

স্ত্রী মারুফা বেগম বলেন, মৃত্যুর আগে আমার স্বামী আমাকে বলেছেন তাকে ‘মারধর’ করা হয়েছে। তার কাছে মহিউদ্দিন গাঁজা পায়নি। তাকে চক্রান্ত করে ফাঁসিয়েছে। মারুফা আরও বলেন, আমার স্বামীকে নির্যাতন করে যে হত্যা করা হয়েছে সেজন্য এসআই মহিউদ্দিনের বিচার করতে হবে। 

তিনি বলেন, আমার স্বামী সিগারেট খেত। কিন্তু আমার বিয়ের ৭ বছরে কখনও তাকে গাঁজা সেবন বা নেশা করতে দেখিনি। তাহলে কিভাবে হঠাৎ করে তার কাছে মাদকদ্রব্য পেল তা তদন্ত করে দেখতে হবে।

মারুফা বলেন, গত বছরের (২০২০) আগস্ট মাসে আমার স্বামীকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এসআই মহিউদ্দিন আটক করে একটি মামলা দেন। তার কাছে কিছু পায়নি। তারপরও মামলা দিয়েছে। মামলার তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। এখন আবার নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে গিয়ে মেরে ফেলেছে।

রেজাউলের শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন :

মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন একাধিক স্থানীয় প্রতিবেশি। তারা দাবি করেন, নিহত রেজাউলের পায়ে ও শরীরে রক্ত জমাট বেধে ছিল। রেজাউলের হাঁটুতে, দুই পায়ের মাঝখানে (অন্ডকোষের পাশে) ব্যান্ডিজ করা ছিল। স্থানীয়দের ধারণা, ভারী কোনো বস্তু থেকে দুই পায়ের মাঝখানে আঘাতের কারণে ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে। নির্যাতনের কারণে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা গেছেন রেজাউল করিম। 

এ বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন। তবে রেজাউল করিমকে হাসপাতালে রিসিভকারী শেবাচিমের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ হরে কৃষ্ণ সিকদার বলেন, প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের জটিলতা নিয়ে রেজাউলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি শনিবার রাত ১২টা ৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। ভর্তির সময়ে দুই পা থেকে অবিরত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল বলেও জানান তিনি।

এলাকাবাসীর বিক্ষোভ :

মৃত্যুর পর রোববার দুপুরে রেজাউলের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের হাতে বুঝিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিকেল চারটার দিকে লাশবাহী গাড়িটি পৌঁছে সাগরদী হামিদ খান সড়ক এলাকায়। এ সময় স্থানীয়রা রেজাউলের মরদেহ ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে রেখে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে। বিক্ষুব্ধরা এসাআই মহিউদ্দিনের ফাঁসির দাবি করেন। এ সময় কোতোয়ালি থানার সহকারী কমিশনার মো. রাসেল, ওসি নুরুল ইসলামসহ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

তারা উত্তেজিত জনতাকে আশ্বস্ত করেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে বিক্ষোভ শেষে এলাকাবাসী মরদেহ মহাসড়ক থেকে সরিয়ে নেন। তবে তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যান। এতে করে মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। স্থবির হয়ে পড়ে বরিশাল নগরী।

 সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসী

অভিযুক্ত এসআইয়ের বাসভবনে হামলা :

রোববার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে নিহত রেজাউলের মরদেহ বিক্ষুব্ধরা নিয়ে যান এসআই মহিউদ্দিনের শেরে বাংলা সড়কের বাসভবনের সামনে। সেখানেও কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক জনতা বিক্ষোভ করতে থাকে। তারা এসআই মহিউদ্দিনের ফাঁসির দাবি জানিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে উত্তেজিত জনতা মহিউদ্দিনের বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। তাতে মহিউদ্দিনের বাসভবনের জানালার গ্লাস ভেঙে যায়। তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নেয়া হয়। 

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল ইসলাম জানান, বিষয়টি ঊর্ধতন কর্মকর্তারা নজরদারি করছেন। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ময়নাতদন্ত রির্পোটে নির্যাতনের বিষয়টি প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পুলিশের দাবি নির্যাতনে মৃত্যু নয় :

ওদিকে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে ই-মেইল বার্তায় দাবি করা হয়েছে রেজাউল করিম নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেনি। পুলিশের দাবি, রেজার বাম পায়ের সংযোগস্থলে ক্ষত ছিল। সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হয়েই মৃত্যু হয়েছে রেজার। রোববার (৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে ওই ই-মেইল গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। 

পুলিশ আরও দাবি করেন, রেজাউল আগে থেকেই এলাকায় মাদক বিক্রেতা ও মাদকসেবী হিসেবে চিহ্নিত ছিল। তার বিরুদ্ধে মাদক সংক্রান্ত একাধিক মামলা রুজু হয়েছিল। তার শরীরের বাম পায়ের পাশের কুকচিতে ক্ষত ছিল। ১ জানুয়ারি ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে চিকিৎসার জন্য শেবাচিম হাসপাতালে পাঠান এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। রেজাউল করিমকে  মাদকদ্রব্যসহ গ্রেফতারের পর পুলিশ যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আদালতে পাঠান। পুলিশের পক্ষ থেকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো কিছুই করা হয়নি।

এসপি