মুন্সীগঞ্জে  ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৩৭২ জন ডেঙ্গু রোগী জেলা সদরের জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চিকিৎসা নিয়েছেন আরও কয়েক গুণ। এদের মধ্যে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে চারজনকে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ২৭ জন ডেঙ্গু রোগী শুধু মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের জন্য আলাদা ডেঙ্গু কর্নার তৈরি করা হলেও ওয়ার্ডে সংকুলান হচ্ছে না রোগী। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালের বারান্দায় ফ্লোরে।  রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিনে শনিবার দুপুরে মুন্সীগঞ্জ সদর জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ওই হাসপাতালের মহিলা ডেঙ্গু ওয়ার্ডের সামনে ফ্লোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন কমপক্ষে ১০/১২জন রোগী। হাসপাতালের সিঁড়ির সামনেও চিকিৎসা নিচ্ছেন বেশ কয়েকজন।

হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা গেছে, যারা ফ্লোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা অধিকাংশই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ বছর ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে আটজন, ফেব্রুয়ারিতে একজন, মার্চে একজন, মে মাসে সাতজন, জুনে ছয়জন, জুলাইয়ে ১৩ জন, আগস্টে ৩১ জন, সেপ্টেম্বরে ১৪৮ জন ও অক্টোবরে এ পর্যন্ত ১২৩ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। 

ঘনঘন বৃষ্টিতে শহরে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব প্রজনন ক্ষেত্র  ধ্বংস না হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। তাদের অভিযোগ আগে নিয়মিত মশার ওষুধ শহরে দেওয়া হতো। কিন্তু গত ৫ আগস্ট  মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হলে নাগরিক অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে মুন্সীগঞ্জ শহরের লোকজন। ঢিমেতালে চলছে এখন মশা নিধন কার্যক্রম। ঠিকমতো মশা নিধন না হওয়ায় মুন্সীগঞ্জ পৌরসভা ও মিরকাদিম পৌরসভা এবং আশপাশের এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। আর এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় শহরের বিভিন্নস্থানে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতার। এতে মশার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। মুন্সীগঞ্জ শহরের ইসলামপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর দেখা মিলেছে শহরের উত্তর ও দক্ষিণ ইসলামপুর মহল্লায়। জলাবদ্ধতা এবং বৃষ্টির পানি জমে থাকায় এডিস মশার বংশ বিস্তার বাড়ছে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নিহাত মিয়া বলেন, আমার বাসা ইসলামপুর এলাকায়। মশার অত্যাচারে শুধু রাতে নয়, দিনেও শান্তিতে থাকা যাচ্ছে না। শহরের সব এলাকায় মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। একই রকম মন্তব্য করেন চিকিৎসাধীন ফারিয়া আক্তার নামে এক গৃহবধূ।

মিরকাদিম পৌরসভার গোয়ালঘুগ্নি এলাকার বাসিন্দা সুমন বেপারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে পৌরএলাকার বিভিন্ন জায়গায় মশার উপদ্রব বেড়েই চলেছে। তবুও মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়নি পৌর কর্তৃপক্ষ। একাধিকবার তাদের জানালেও কাজ হয়নি।

এলাকাবাসী বলেন, পৌর এলাকার বেশির ভাগ বাসাবাড়িতে নালার ব্যবস্থা নেই। সড়কের পাশেও নালা নেই। তাই বৃষ্টি হলেই পানি জমে বংশবিস্তার করে মশা। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, শরীর ও মাথায় তাদের প্রচণ্ড ব্যথা। জ্বরের সঙ্গে বমিও হচ্ছে।

মুন্সীগঞ্জ ও মিরকাদিম পৌরসভা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে টানা বৃষ্টিতে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। নালাতেও জমে আছে ময়লা। বাসাবাড়ির বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি ও জলাশয়গুলো যেন এডিস মশার বংশবিস্তারের অভয়ারণ্য। অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে কয়েল বা স্প্রে ব্যবহার করেও মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না লোকজন। মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার উত্তর ও দক্ষিণ ইসলামপুর, খালইস্ট, মধ্য কোটগাঁও, দেওভোগ, মালপাড়া এলাকায় দিনের বেলায়ও কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে দেখা যায়। শহরের উত্তর ও দক্ষিণ ইসলামপুর মহল্লায় বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, বৃষ্টির পানি জমে থাকায় এডিস মশার বংশবিস্তার বেড়েছে। অন্যদিকে জেনারেল হাসপাতালে জ্বরসহ মশাবাহিত রোগে চিকিৎসা নিতে দেখা যায় শিশু-বৃদ্ধসহ নানা বয়সী মানুষকে।

জানা গেছে, সকাল হলেই হাসপাতালে টিকিটের জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। এর অধিকাংশই জ্বরে আক্রান্ত। চিকিৎসকদের তথ্যমতে, মশাবাহিত বিভিন্ন রাগে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে টিকিট কেটে চিকিৎসা নিয়েছেন ছয় শতাধিক মানুষ। জ্বরে আক্রান্ত অসংখ্য মানুষের মধ্যে ডেঙ্গুর সব লক্ষণ পেয়েছেন, তবে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত না হওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন।

হাসপাতালে ভর্তি রোগীর স্বজনরা জানান, এ বছর ওষুধ স্প্রে কমেছে তাই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তারা বলছেন, ঢাকায় যে পরিমাণ মশার ওষুধ দেওয়া হয় মুন্সীগঞ্জে সেই পরিমাণ ওষুধ দিতে দেখা যায় না। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কোনো ব্যবস্থা নেই। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি।

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সাইদুর রহমান হিমেল বলেন, জেলাজুড়ে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়েই চলেছে। দিনে অন্তত ১৫ জন মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই মশা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

মুন্সীগঞ্জের সিভিল সার্জন মনজুরুল আলম বলেন, মশার বংশবিস্তার ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাধারণ মানুষেরও ভূমিকা রাখা উচিত।

মুন্সীগঞ্জের ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবু হেনা মো. জামাল বলেন, অসময়ে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তা ছাড়া মুন্সীগঞ্জে মশা নিধন যে কার্যক্রম তা যথাযথ হচ্ছে না। যার কারণে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ সচেতনেতার অভাবে অনেকে মশারি না টাঙিয়েই ঘুমাচ্ছেন যার কারণে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

তবে মেঝেতে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার করা হয়েছে। মেঝেতে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ডেঙ্গুতে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া পাশাপাশি জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেন তিনি।

ব.ম শামীম/এএমকে