ফেনীতে জুলাই-আগস্টে পরপর তিন দফা বন্যায় জনপদে কৃষিখাতে হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। ফলে আগামীতে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এর মাঝে কৃষকের নতুন ভীতি ফসল বিনাশী ‘ফল আর্মিওয়ার্ম’ পোকার মারাত্মক আক্রমণ দেখা দিয়েছে। 

জানা গেছে, সপ্তাহখানেক ধরে জেলার সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ, নবাবপুর ও ফুলগাজী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থানে ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। বন্যার পানিতে এ পোকা ভেসে এসেছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় কৃষকরা। 

কৃষি বিভাগ বলছে, ফসলের জন্য ক্ষতিকর এ পোকা দমনে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করছেন তারা। অন্যদিকে কৃষকরা বলছেন, জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করেও পোকা দমন করা যাচ্ছে না।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) সোনাগাজীর আমিরাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কালো রঙের অসংখ্য পোকা ফসলের মাঠে, রাস্তায়, বাড়িঘর ও আশপাশের বন-জঙ্গলে বিচরণ করছে। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে এই পোকা পানিতে থাকতে পারে না। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে বিপরীত চিত্র। সেখানে পুকুর, ডোবা-নালাসহ আমন ধানের মাঠে পানি থাকলেও পোকাগুলো পানি ওপর দিয়েই হেঁটে বেড়াচ্ছে ও একস্থান হতে অন্যস্থানে চলাচল করতে দেখা গেছে।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, বন্যার পর জমিতে আমন ধান আবাদ করেছেন তারা। এছাড়া বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম শীতকালীন সবজি লাউ, কুমড়া, করলা, জিঙ্গা, পাট শাক আবাদ করেছেন, সপ্তাহখানেক পর সেগুলো বিক্রির উপযোগী হতো। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এ পোকার ব্যাপক আক্রমণ। পোকার আক্রমণ কমাতে জমিতে কীটনাশক ছিটিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। পোকার আক্রমণে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন তারা। একই কথা বলছেন ফুলগাজী উপজেলার কৃষকরাও। সেখানেও ফসলের মাঠে এ পোকার আক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করেছে।

আমিরাবাদের আহম্মদপুর এলাকার কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ১২ শতক জমিতে লাউ গাছের চারা রোপণ করেছিলাম। হঠাৎ এ পোকা এসে সবগুলো গাছের মূল কেটে দিয়েছে। এতে গাছগুলো শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি অফিসের পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করেও লাভ হয়নি। পোকাগুলোকে কীটনাশকের পানিতে রাখলেও মরে না।

চর কৃষ্ণজয় গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, এতো পোকা আমার ৫৫ বছরের জীবনে কখনো দেখিনি। দেখতেও কেমন ভয় লাগে, কাছে গেলে শরীরে উঠে যায়। জমির পাশাপাশি এখন বাড়িঘরেও ঢুকে পড়েছে। এভাবে হলে মাঠের ফসল আর বাড়িতে তোলা সম্ভব না। 

কৃষক মোস্তফা বলেন, বন্যার ক্ষতি কাটাতে ৬০ শতক জমিতে আগাম শাকসবজি আবাদ করেছিলাম। এখন সেগুলোও পোকায় নষ্ট করে ফেলছে। চেষ্টা করেও ফসল বাঁচাতে পারছি না।

এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাঈন উদ্দিন আহমেদ সোহাগ বলেন, এ পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষায় কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পোকা দমনে ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের টিম কাজ করছে। কৃষি বিভাগ মাঠপর্যায়ে থেকে কৃষকদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।

একই প্রসঙ্গে ফুলগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, ফুলগাজীর আমজাদহাট ইউনিয়নের মনিপুর ও মুন্সীরহাটের দক্ষিণ শ্রীপুর এলাকায় পোকার আক্রমণ বেশি লক্ষ্য করা গেছে। পোকার উপদ্রব ঠেকাতে তিন ধরনের ওষুধ ছিটানো হয়েছে। কীটনাশক নাইট্রো ও কোরাজেন মিশ্রিত স্প্রে করে পোকা দমন করা হচ্ছে। বন্যার সময় কিছু কীটের লার্ভা ফসলের মাঠে আগাছার সঙ্গে মিশে থাকায় এ পোকা বৃদ্ধি পেয়েছে। 

পোকায় ছেয়ে গেছে বসতবাড়িও

কেবল ফসলের মাঠ নয়, ঘরবাড়িতেও ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার উপদ্রব বেড়েছে। সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের চর কৃষ্ণজয় গ্রামের কৃষক ছুট্টো মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়ির রাস্তা, বসতঘর, টিউবওয়েল, শৌচাগার, বাড়ির আঙিনায় হাজার হাজার পোকা কিলবিল করছে। 

কৃষক ছুট্টো মিয়া বলেন, এ ভয়ংকর পোকা আগে কখনো দেখিনি। বাড়িতে এতো পোকা ঢুকেছে যে আমরা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেও পারছি না। রাতে ঘুমালে পোকা গায়ে উঠে যায়। শৌচাগারে পানিও ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। বাড়ির চারদিকে কীটনাশক ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না, দিন দিন পোকা বাড়ছে। এ অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

লেমুয়া ইউনিয়নের কসবা গ্রামের বাসিন্দা সিএনজি অটোরিকশা চালক বেলাল বলেন, পোকার উপদ্রবে বাড়িতে ঠিকভাবে হাঁটা-চলা করা যাচ্ছে না। কালো রঙের ৩-৪ ইঞ্চির এ পোকা দেখতেও ভয় লাগছে। ইতোমধ্যে ফসলের ক্ষেতে আক্রমণে সব শেষ হয়ে গেছে। বাড়িতে এখন ছোট ছোট শিশু সন্তানদের নিয়ে বেশি বিপাকে রয়েছি।

অনুকূল আবহাওয়ায় বংশবিস্তারের শঙ্কা

ফসল বিনাশী ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার আক্রমণে জেলায় ফসল উৎপাদনে ফের বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে কথা হয় ফেনী সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোতাহার হোসাইনের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বন্যা এ পোকার উপদ্রবের অন্যতম কারণ হতে পারে। পোকাটি সাধারণত মাঝারি ঠাণ্ডা ও গরমে বেশি বংশবিস্তার করে। বর্তমান সময়ের আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি অনুকূলে রয়েছে। যা আমাদের জন্য বাড়তি শঙ্কার বিষয়।

মোতাহার হোসাইন বলেন, গ্রীষ্মকালে পোকাটি ৩০-৩৫ দিনে ও শীতকালে ৭০-৮০ দিনের জীবনচক্র সম্পন্ন করে। স্ত্রী জাতের পোকা সাধারণত পাতার নিচের দিকে ১৫০০-২০০০টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীট বের হয়ে পাতা বা ফল খাওয়া শুরু করে। পূর্ণাঙ্গ কীট মাটির ৮-১২ সেন্টিমিটার নিচে পুত্তুলিতে পরিণত হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় পোকাটি ৪-৫টি জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপে পূর্ণাঙ্গ পোকা অনেকদূর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। এমনকি ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে কয়েকশ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তিনি আরও বলেন, পোকাটির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজারে রিপকর্ড নামে কার্যকরী একটি স্প্রে জাতীয় ওষুধ রয়েছে। কৃষকরা যদি যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেন, তাহলে ২০ শতাংশ ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতা নিয়ে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

 

যা বলছেন কৃষি বিভাগ 

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ আমেরিকার এ পোকা আনুমানিক পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশে প্রথম দেখা মেলে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে ফেনীর সোনাগাজী ও ফুলগাজী উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় এ পোকার দেখা মিলেছে। এতে জেলার আগামীর কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে কার্যক্রম শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) জেলায় প্রথমবারের মতো এ পোকার উপদ্রবের বিষয়ে অবগত হয়েছি। এখন পর্যন্ত সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ও আমিরাবাদ এবং ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর এলাকায় এ পোকার দেখা মিলেছে বলে জেনেছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন। বিভিন্ন বালাইনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিদেরও এতে যুক্ত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে জমিতে আলোর ফাঁদ ও পাখি বসার মত কিছু বসাতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বাজার থেকে বিভিন্ন বালাইনাশক প্রয়োগের বিষয়েও কৃষকদের বলা হচ্ছে। ফসল অনুযায়ী জমিতে সম্ভব হলে পানি রাখতেও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে শঙ্কা থাকলেও এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, বাকিটা আল্লাহর উপরই। মাঠ পর্যায়ে থেকে এ ব্যাপারে কৃষকদের সহায়তা করতে কৃষি বিভাগ সচেষ্ট রয়েছে বলে জানান এ কৃষিবিদ।

আরকে