পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশ শিকার যেন থামছেই না। প্রতিদিনই পালাক্রমে অভিযান পরিচালনা করছে প্রশাসন। আটক হচ্ছে জেলে, নৌকা ও জাল। কিন্তু সুযোগ পেলেই জাল ও নৌকা নিয়ে নদীতে ছুটছেন জেলেরা। এ যেন এক চোর-পুলিশ খেলা। জেলেদের দাবি, পেটের দায়েই নদীতে মাছ শিকারে যান তারা। অভিযোগ উঠেছে মাছ শিকারে জেলেদের সঙ্গে মৎস্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। এদিকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে শরীয়তপুর মৎস্য বিভাগের দাবি, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর অভিযান সফল হয়েছে।

চলতি বছর মা ইলিশ রক্ষায় সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ সময়ের প্রথম দিন থেকেই এমন চিত্র দেখা গেছে শরীয়তপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীতে।

মৎস্য বিভাগ, নদীপাড়ের বাসিন্দা ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মা ইলিশ রক্ষায় এ বছর ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত নদীতে সব ধরনের মাছ শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে মাছ ধরতে নদীতে নামলে আটক ব্যক্তির সর্বোচ্চ ২ বছরের জেল, ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।

শরীয়তপুর জেলার চারপাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা ও মেঘনার মতো বড় বড় নদী। জেলার ভেতরে প্রবাহিত হয়েছে কীর্তিনাশা, জয়ন্তিকাসহ পদ্মার অসংখ্য শাখা নদী। নদী বেষ্টিত জেলা হওয়ায় নদীপাড়ের বসবাসরত অধিকাংশ মানুষেরই পেশা হয়ে উঠেছে মাছ শিকার। মাছ শিকারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আড়ত ও মৎস্য ব্যবসায়ী। জেলার প্রায় ৮৭ কিলোমিটার প্রবহমান নদীর মধ্যে চাঁদপুরের সাটনল থেকে শরীয়তপুরের কাঁচিকাটা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকাকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের খাদ্য সহায়তা হিসেবে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। তবে জেলেদের দাবি, ২৫ কেজি চাল দিয়ে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবনধারণ করা কষ্টকর হয়ে যায়। একরকম বেঁচে থাকার তাগিতেই নিষিদ্ধ সময়েও জাল নিয়ে নদীতে যান মাছ শিকারে যান তারা। আবার অনেকেই বলছেন জেলে হলেও জেলে কার্ড না থাকায় সরকারের দেওয়া খাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে।

মা ইলিশ রক্ষায় প্রশাসনের অভিযানে প্রতিদিনই আটক হচ্ছে জেলে, নৌকা ও জাল। তবুও থামানো যাচ্ছে না মা ইলিশ শিকার। প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েই বেচা-কেনা হচ্ছে ইলিশ। এ যেন এক চোর-পুলিশ খেলা। দিন যতই যাচ্ছে ততই ইলিশ শিকারে আগ্রাসী হয়ে উঠছে জেলেরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলেদের মা ইলিশ শিকারের সঙ্গে মৎস্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিন থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রশাসন ১৮৮টি অভিযান পরিচালনা করে ১৭ লাখ ৭৯০ লাখ মিটার কারেন্ট জালসহ ১৫৩ জন জেলেকে আটক করে জেল-জরিমানা করেছে। মাছ শিকারে জেলেদের সঙ্গে মৎস্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ।

আবুল বাদশাহ মাদবর নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মৎস্য কর্মকর্তার ড্রাইভারসহ অন্যান্যরা একটি মাছ ধরার ট্রলার আটক করছে। মৎস্য অফিসার ফোন করে সেই ট্রলার ছেড়ে দিতে বলেছে। জেলেরা মৎস্য অফিসারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে নদীতে মাছ ধরছে। মৎস্য অফিসার টাকা খেয়ে এসব করছে। মৎস্য অফিসার যদি ঘুষ খায়, তবে কে কী বলব বলেন?

আফছার উদ্দিন নামের এক জেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মাছ ধরি, মাছ না ধরলে তো আমরা ভাত খেতে পারব না। আমাদেরকে তো কেউ খাবার দেবে না। নদীতে জাল না পেতে কী করব?

আব্দুল হক নামের আরেক জেলে বলেন, নদীতে মাছ ধরা ছাড়া কীভাবে চলব আমরা? আমাদের জেলে কার্ড নেই। সরকারি কোনো সাহায্যও পাইনি। পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমাদের মাছ ধরতে হয়। মাছ না ধরলে কিস্তি দিতে পারি না।

ওহিদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৭ জন। সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমার পেশাই মাছ ধরা। ১২ মাস মাছ ধরে চলি। সরকার ২২ দিনের এই নিষেধাজ্ঞার সময়ে যদি সকল জেলেকে ভালোভাবে সাহায্য করত, তাহলে মাছ না ধরেও পারতাম। বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা, কিস্তি, সংসার খরচসহ ইত্যাদি কারণে এখন বাধ্য হয়েই মা ইলিশ শিকার করতে হয় আমাদের।

আহাদ নামের এক জেলে বলেন, চাল, ডাল সব কিনে খেতে হয় আমার। ১২ মাস মাছ ধরলেও তখন ঋণী হয়ে যাই। অভিযানের সময় বেশি মাছ পাওয়া যায়। পেছনের ঋণ দেওয়ার আশায় অভিযানের সময় মাছ শিকার করি আমরা। অভিযানে মাছ ধরার কারণে প্রশাসন নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে। এতে আমার ৩০-৩৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। এখন মাছ না ধরলে এই ক্ষতি পূরণ করব কীভাবে?

শরীয়তপুরের মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৩ অক্টোবর থেকে অভিযান শুরু হয়েছে। আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে। দিন-রাত নদীতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। অভিযান সফল করতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড সবাই সহযোগিতা করছে। এ বছরের অভিযান অন্যান্য যেকোনো বছরের তুলনায় অধিকতর সফল হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মৎস্য কর্মকর্তা ঘুষ লেনদেন করেন, এমন কোনো বিষয় আমাদের জানা নেই। যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাই, তবে সেটা তদন্ত করে দেখা হবে। নদীতে কোনো জেলে নৌকা নেই, একেবারেই প্রত্যন্ত জায়গায় থাকতে পারে। সেটাও আমরা অভিযানের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এমজেইউ