পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার বালিপাড়া ইউনিয়নের বলেশ্বর নদীর পাড়ের চন্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা ফরিদা বেগম। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর তার কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে সাত বছর বয়সের মেয়ে মিমি ও তিন বছর বয়সের রিনাকে। সেই দিনের ভয়াল স্মৃতি কিছুইতে মনে করতে চান না তিনি। এ সময় ভেসে গিয়েছিল তাদের বসতঘরও। সেই থেকেই ঘূর্ণিঝড়ের খবর শুনলেই দুশ্চিন্তা বাড়ে ফরিদার মলিন হয়ে যায় মুখ। নদীর তীরের বেড়িবাঁধ ভাঙা থাকায় দুশ্চিন্তা আরও গভীর হয়।

বুধবার (২৩ অক্টোবর) কথা হয় ফরিদা বেগমের সাথে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের খবর আইলেই বুক কাঁপতে থাহে কহন কি হয়। হের পরে আবার বেড়ি বাঁধ না থাহায় মোরা ম্যালা বিপদে থাহি। গাঙ্গের ঢেউর পানি সব ঘরে ওডে, চাইরো কুল সব তলাইয়া যায়। ভয়তে থাহি আবার কোন সময় সিডরের নাহান পানিতে সব ভাসাইয়া লইয়া যায়। মোর মত আর যেন কেউর কোল খালি না অয়।
 
পিরোজপুরের সাতটি উপজেলার প্রায় সব গুলোই নদীবেষ্টিত। তাই নদী তীরবর্তী বাসিন্দার সংখ্যাও এখানে অনেক বেশি। কিন্তু নদী তীরবর্তী অধিকাংশ এলাকায় বেড়ি বাঁধ না থাকায় হুমকির মুখে রয়েছে ওই সব এলাকার বাসিন্দারা। ছোটখাটো ঘূর্ণিঝড়েই পানি উঠে যায় তাদের ঘরে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে ইন্দুরকানী উপজেলাটি বিদ্ধস্ত জনপদে পরিনত হয়েছিল ২০০৭ সালে। বিদ্ধস্ত হয় নদী তীরের সকল বেড়িবাঁধ। তারপর থেকে নামে মাত্র সংস্কার হয়েছে বেড়িবাঁধের। সামান্য জোয়ারে লোকালয় পানিতে প্লাবিত হয়। ডুবে যায় ফসলের ক্ষেত। আবার লবনাক্ত পানিও জোয়ারের সঙ্গে প্রবেশ করে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে। জোয়ারের পানির সঙ্গে ভেসে আসা কচুরিপানা জমে যায় ফসলের ক্ষেতে। ডুবে যায় যাতায়াতের পথ। পানির চাপে ভেঙে যায় বসতঘরের মাটির তৈরি মেঝে। ভেসে যায় মাছের ঘের। স্কুলগামী শিশু শিক্ষার্থীদের বন্ধ হয়ে যায় স্কুলে যাতায়াত। সব মিলিয়ে দিশেহারা স্থানীয়রা।

ইন্দুরকানী উপজেলার পত্তাশী ইউনিয়নের চাড়াখালী গুচ্ছগ্রামের কহিনুর বেগম বলেন, জোয়ার আসলেই উঠান বাড়ি সব তলিয়ে যায়। তারপরে আবার যেকোনো ঘূর্ণিঝড়েই অনেক বিপদে পড়ে যাই। ঘর দিয়া বাইরে নামা যায় না। ছেলে মেমে নিয়ে খাটের ওপরে বসে থাকতে হয়। চুলায়ও পানি উঠে যায়। রান্না খাওয়ারও উপায় থাকে না। সরকারের কাছে ত্রাণ সহায়তা নয়, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি যাতে ঘূর্ণিঝড় এলেও তারা চিন্তা মুক্ত থাকতে পারেন।

পিরোজপুর সদর উপজেলার বলেশ্বর নদী তীরের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, নদীর পাড়ে ঘর হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় এলেই ঘরে পানি উঠে যায়। এসময় আমরা খুব বিপদে থাকি।

মঠবাড়িয়া উপজেলার বড় মাছুয়া ইউনিয়নের সেগুরবাড়িয়া গ্রামের বেল্লাল হোসেন বলেন, আমরা নদীর পাড়ের মানুষ ঝড় বন্যা এলেই ঘরে পানি উঠে। সব ভাসাইয়া নিয়ে যায়। টেকসই বেড়িবাঁধ হলে আমরা বিপদ মুক্ত হতে পারি।

পিরোজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নুসাইর হোসেন বলেন, সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে কচাঁ ও বলেশ্বর নদীর নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধসহ পুরোনো বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে। দ্রুত এসব বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করা হবে।

এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় দানার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় পিরোজপুরে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান বলেন, দুর্যোগের সময় দুর্যোগ কবলিতদের আশ্রয় দেওয়ার লক্ষ্যে ২৯৫টি সাইক্লোন শেল্টার এবং ২৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ মোট ৫৬১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে দুই লাখ ৮০ হাজার ৫০০ জন আশ্রয় নিতে পারবেন। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষসহ প্রতিটি উপজেলায় একটি টিম করা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে ৬৫টি মেডিকেল টিম। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় রেড ক্রিসেন্টের ২৫০ স্বেচ্ছাসেবক ও দুই হাজার ৪২০ জন সিপিপি সদস্যও প্রস্তুত আছেন। এছাড়াও দুর্যোগ কবলিতদের জন্য পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, চাল ও শিশু খাদ্য ক্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ মজুত রয়েছে।

শাফিউল মিল্লাত/আরকে