ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার কাপাশাটিয়া ইউনিয়নের কেসমত ঘোড়াগাছা গ্রামে তিন কৃষকের ১৬৩ শতক জমির পান বরজ উপড়ে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার (২১ অক্টোবর) রাতে এ ঘটনা ঘটে। কৃষকদের দাবি, দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে পান, কলা, পটলসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের ক্ষতি করে আসছে দুর্বৃত্তরা।

হরিণাকুন্ডু উপজেলার কেসমত ঘোড়াগাছা গ্রামের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, সবুজে ঘেরা ফসলের মাঠ, সারি সারি পানক্ষেত। তার ও শোলা দিয়ে ঘিরে রাখা পানক্ষেতের ভেতরে দেখা যায়, খণ্ড খণ্ড পানক্ষেতের পান গাছের গোড়া থেকে সব গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে। কৃষকেরা উপড়ে ফেলা পান গাছগুলো মেরামত করার চেষ্টা করছে। কিছু কিছু পান গাছ মরে শুকিয়ে গেছে। আবার নতুন করে উপড়ে ফেলা গাছগুলো থেকে পান নষ্ট হওয়ার আগ থেকেই কিছু পান সংগ্রহ করা হচ্ছে। পানচাষিদের যে ক্ষতি হয়েছে দুই-এক বছরের মধ্যে সেই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে ওই মাঠে ১৬৩ শতক পানক্ষেত নষ্ট হয়েছে, যা টাকার পরিমাণে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা।

হরিণাকুন্ডু উপজেলার কৃষি অফিস থেকে জানা যায়, হরিণাকুন্ডুতে ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে পান চাষ করেন কৃষকেরা। এই উপজেলার পান খুবই সুস্বাদু। যার কারণে সারা দেশে এই পানের চাহিদা অনেক। আবার কিছু বাছাইকৃত পান দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। উপজেলার কাপাশাটিয়া ইউনিয়নের কেসমত ঘোড়াগাছা গ্রামের মাঠে বেশ কিছুদিন ধরে দুর্বৃত্তরা কৃষকের পান বরজের ক্ষতি করে আসছে। এতে করে পানচাষিরা আর্থিকভাবে লাখ লাখ টাকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত পানচাষি লিটন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১১ সাল থেকে পান চাষ করি। এর আগে কখনো আমার পান বরজে কোনো ক্ষতি হয়নি। আমাদের মাঠে কলা, পান, পটল ও বেগুন ক্ষেত কেটে দিত দুর্বৃত্তরা। এবার আমাদের পান গাছ উপড়ে দিয়েছে। গত এক মাস ধরে আমারসহ ছয়জন পানচাষির ৮ বিঘার জমির উপর পান গাছ উপড়ে দিয়েছে। আমার নিজের প্রথমে ৩৬ শতক জমির পান গাছ উপড়ে দেয়, এক সপ্তাহ পর ২০ শতক জমির পান উপড়ে দিয়েছে। আজ আবার আমার ছোট ভাইয়ের ১৮ শতক এবং আমার ১৯ শতক জমির পান গাছ উপড়ে দিয়েছে। কে বা কারা এই পান গাছ উপড়ে দেয়, আমরা আবার অনেক কষ্ট করে সেই গাছ ঠিক করার পর আবারও উপড়ে দিয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, গতকাল আমরা সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পান বরজ পাহারা দিয়ে বাড়ি গেছি। সকালে মাঠে এসে দেখি পান গাছের গোড়া থেকে সব উপড়ে ফেলেছে। দুই-তিন বছরের মধ্যে টাকার অঙ্কে প্রায় ৭২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কোনোভাবেই পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। গাছ উপড়ে দেওয়ার পর গাছে যে পান আছে বর্তমান বাজারে সেগুলো অর্ধেক দামে ৫০ টাকা পোন (৮০ পিস পানে এক পোন) দরে বিক্রয় করতে হবে। অথচ এই পান দুই মাস পর বিক্রয় করতে পারলে ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রয় করা যেত।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মিল্টন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল সারাদিন বরজে কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়িতে গেছি। আমার কাজ মাঠে পান বরজে কাজ করা আর নামাজ পড়া। আজ সকালে মাঠে এসে দেখি পানের পাতা নেতিয়ে গেছে। পরে দেখি কে বা কারা পান গাছের গোড়া থেকে সব গাছ উপড়ে দিয়ে গেছে। এ ঘটনায় আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। কারও সঙ্গে কোনো ধরনের শত্রুতাও নেই। তাহলে কেন আমার এমন ক্ষতি করলো। এর আগে আমার ভাইদের পান গাছ উপড়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। থানায় অভিযোগ করা হয়েছিল, ইউনিয়ন পরিষদেও অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলাতেও জানানো হয়েছে তবুও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ১৫/১৬ বছর ধরে আমাদের মাঠে এই ধরনের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু আজও ধরা পড়েনি কে বা কারা এসব করছে।

ক্ষতিগ্রস্ত আরেক কৃষক হিটলার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেসমত ঘোড়াগাছা গ্রামের মাঠে ৩৫ শতক জমিতে পানের আবাদ করেছি। সন্তানের মতো করে পান ক্ষেত যত্ন করে রেখেছি, সামনের সিজনে ভালো দাম পাব বলে। কিন্তু এক মাসের মধ্যে পাশাপাশি সব বরজের পান উপড়ে দিয়েছে। আমার ক্ষেতবোঝাই পান, ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার পান ছিল বরজে। সেই পান গাছ সব উপড়ে দিয়েছে। কারা এই কাজগুলো করে তা আজও ধরতে পারিনি। এই নিয়ে হরিণাকুন্ডু থানায় অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। আমাদের দাবি এই কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

হরিণাকুন্ডু উপজেলা কৃষি অফিসার শরীফ মোহাম্মদ তিতুমীর ঢাকা পোস্টেকে বলেন, যারা কৃষকের বরজের পান গাছ উপড়ে দিয়েছে তারা দুর্বৃত্তকারী। এই ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকলে আমার দপ্তর তার পাশে থাকবে। আইনগত সহায়তার জন্য থানায় অভিযোগ করলে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করব। এ ছাড়া বরজের ক্ষতিগ্রস্ত অংশে পুনরায় চারা রোপণ করতে পারলে হয়ত কিছুটা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে।

হরিণাকুন্ডু থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মো. জিয়াউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কৃষকের পান বরজের গাছ উপড়ে ফেলা খুবই দুঃখজনক। এখনো পর্যন্ত ভুক্তভোগী কৃষকরা আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি। কৃষকরা আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

আব্দুল্লাহ আল মামুন/এমজেইউ