গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলা শেরপুরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। কাজগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন সাধারণ জনগণের ভোগান্তি বেড়েছে অন্যদিকে গ্রামীণ সড়ক, ব্রিজ, কালভার্টের অসমাপ্ত অংশে নষ্ট হচ্ছে সরকারি সম্পদ। এদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) বলছে, পলাতক বা আত্মগোপনে থাকা ঠিকাদারদের চূড়ান্ত নোটিশ করা হলেও কাজে ফিরছেন না অনেকেই। এর ফলে তাদের চুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তির পরিকল্পনা করছে সরকার।

কাজ বন্ধ থাকায় যেসব এলাকায় ভোগান্তি বেশি হচ্ছে তার একটি শেরপুরের ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার বিকল্প সংযোগ সড়কের চাপাতলী সেতু। এই সেতু দিয়ে দুই উপজেলার ধানশাইল, ভটপুরসহ ১০ গ্রামের মানুষের যাওয়া-আসার জন্য ৩ কোটি ৯ লাখ টাকার চুক্তিতে গত বছরের মার্চে এই চাপাতলী সেতুর নির্মাণের কাজ শুরু করে ধ্রুব ট্রেড এজেন্সি। এই ঠিকাদারি এজেন্সির মালিক জেলা যুবলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান ও যুবলীগ নেতা আরিফুল ইসলাম উজ্জ্বল ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে সংযোগ সেতুটির কাজ।

চাপাতলী সেতুর মতো একই অবস্থা শেরপুর সদর উপজেলার চৌধুরীবাড়ী মোড় থেকে কামারের চর ইউনিয়নের ৭নং চর এলাকার সড়কের। ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ের চরগুলোতে বসবাস করা দেড় থেকে দুই লাখ মানুষের দুর্ভোগ দূর করার জন্য প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার চুক্তিতে কাজ শুরু করে ভাটি বাংলা এন্টারপ্রাইজ ও বরেন্দ্র কন্সট্রাকশন। এই প্রকল্পের এখনো প্রায় ৬৫ শতাংশ কাজ বাকি। প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর রুমান।

একই অবস্থা উত্তর খড়িয়া থেকে দক্ষিণ খড়িয়া ৫৭ মিটার ব্রিজেরও। শ্রীবরদী উপজেলার উত্তর খড়িয়ায় ব্রিজটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই কাজের চুক্তি হয় মোহাম্মদ ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে ঠিকাদার এজেন্সির সঙ্গে। ৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকায় এই কাজ পায় তারা। উত্তর খড়িয়া ব্রিজের কাজে খুব বেশি কাজ হয়নি বলা যায়। বর্তমানে কাজ বন্ধ থাকায় এই এলাকার মানুষদের প্রায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার পথ ঘুরে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা শেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম কিবরিয়া লিটন, শেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হাসান উৎপল পলাতক রয়েছেন।

এদিকে কাজ শেষ না করেই পালিয়েছেন প্রায় ৬ কোটি টাকার চুক্তিতে শুরু করা ঝিনাইগাতী থেকে মোহনগঞ্জ বাজার সড়কের ঠিকাদার শেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হাসান উৎপল এবং ছাত্রলীগ নেতা জনি ও রাশেদ। পাঁচ উপজেলায় এলজিইডির অধীনে বাস্তবায়িত অধিকাংশ কাজ করতেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক হুইপ আতিউর রহমান আতিক, সংসদ সদস্য ছানুয়ার হোসেন ছানু, মেয়র গোলাম কিবরিয়া লিটন, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হাসান উৎপল, জেলা যুবলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও তাদের সমর্থকরা।

ঠিকাদার পালিয়ে যাওয়ায় শেষ হয়নি শেরপুরের পাঁচ উপজেলার বেশির ভাগ উন্নয়নকাজ। অনেক কাজ এখনো অর্ধেকও হয়নি। কাজগুলো বন্ধ হওয়ায় একদিকে যেমন বেড়েছে ভোগান্তি, অন্যদিকে ক্ষতির মুখে সরকারি সম্পদ। দ্রুত সময়ের মধ্যে চলমান কাজ শেষ করার দাবি স্থানীয়দের।

শেরপুর সদর উপজেলার ৭নং চর এলাকার হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই রাস্তাটা এখন আমাদের গলার কাঁটা। আমাদের এই রাস্তাটি আগেই ভালো ছিল। আমরা এখন না পারি যাতায়াত করতে, না পারি গাড়ি দিয়ে চলতে। আগে বৃষ্টি হলে রাস্তার পানি সাইড দিয়ে নেমে যেত। এখন রাস্তা খনন করে রেখে দেওয়ায় বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি আটকে যায়, রাস্তায় সব সময় কাদা থাকে। আমাদের খুব কষ্ট হয়। এই কাদার মধ্যে ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে পারে না। এই এলাকার রোগীরা হাসপাতালে যেতে পারে না। আমরা চাই এই কাজটা দ্রুত শেষ করে আমাদের কষ্ট লাঘব করা হোক।

ঝিনাইগাতী উপজেলার বাগেরভিটা এলাকার সুরাব আলী বলেন, ‘আমগোর এই সেতুডা দুই বছর ধইরা এমনিই পইড়া রইছে। এইখানে কাঠের দুইটা ব্রিজ দিছিলো, এই বন্যায় ভেঙে গেছে। এই পাড়ের মানুষ ওই পাড়ে যাইতে পারে না। রোগী নিয়া ১০ কিলোমিটার ঘুইরা যাওন লাগে। কি যে একটা অশান্তির মধ্যে আমরা আছি কাউরে বুঝাবার পারি না। এহন শুনতাছি এই কামের ঠিকাদারই নাকি পলাইছে। আমগোর দাবি, ঠিকাদার পলাইয়া থাকলে, প্রয়োজনে নতুন ঠিকাদার দিয়া হইলেও এই কামডা তাড়াতাড়ি শেষ কইরা দেক সরকার।’

ধানশাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই একটি সেতুর জন্য শ্রীবরদী উপজেলা থেকে ঝিনাইগাতীর এই বিকল্প সড়কের মানুষগুলোর দুর্ভোগ এখন চরমে। আমরা ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি জানান, ৫ আগস্টের পর ঠিকাদাররা কাজ করছে না। ঠিকাদারকে কল দিলে তারা রিসিভও করেন না। তারা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ছিলেন, এখন পলাতক। আমাদের গ্রামগুলোর মানুষ খুব কষ্টে আছে। আমরা চাই দ্রুত আমাদের এই কাজটা নতুন ঠিকাদার দিয়ে হলেও শেষ করে দেওয়া হোক।

শেরপুরে এলজিইডির ৮ প্রকল্পের ৪৩৫ স্কিমের ১১২টি চলমান কাজের বেশির ভাগ কাজ করতেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তারা পলাতক থাকায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।

এলজিইডি বলছে, পলাতক বা আত্মগোপনে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজে না ফিরলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শেরপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বন্ধ থাকা কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নোটিশ পাঠিয়েছি। কাউকে ২৮ দিনের আবার কাউকে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। একটি কাজের ঠিকাদার বাতিলের জন্য লেখা হয়েছে। যারা কাজে ফিরতে পারবে না, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমজেইউ