‘কোনো কামের যদি পরিকল্পনাত ভুল হয়, তাইলে ওই কামের টেকসই হয় ক্যামন করি? হামার মহিপুর তিস্তা সেতুর অবস্থা দেখি মনে হয় কামকোনা একেবারে ভালো হয় নাই। আগে নৌকা দিয়্যা ছোট ছোট গাড়ি পার হছলো (হয়েছে)। কারণ তখন সেতু আছলো না (ছিল না)। এল্যা (এখন) সেতু থাকার পর যদি বড় গাড়িগুল্যা পারাপার না হয় তাইলে (তাহলে) এই সেতু নির্মাণ করার তো দরকার আছলোনা (ছিল না)। সরকার তো খামাখা টাকা নষ্ট (গচ্ছা) করছে।’ 

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে তিস্তা সেতু সড়কে ভারী যান চলাচল বন্ধ রাখায় এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন ট্রাকচালক মতিয়ার রহমান। তিনি সপ্তাহে চার দিন পাটগ্রাম থেকে লালমনিরহাট হয়ে রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় পাথর পরিবহন করে থাকেন।

অভিযোগ উঠেছে, ছয় বছরের সেতুতে উদ্বোধনের চার বছর ভারী যানবাহন চলেনি। গত দুই বছর ধরে ওই সড়কে ভারত থেকে আমদানি করা পাথরসহ পণ্য বহনকারী ট্রাক চলাচল শুরু হলেও সড়ক দেবে যাওয়ায় দফায় দফায় তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ওই সড়ক সেতু দিয়ে বন্ধ রয়েছে ভারী যান চলাচল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বাস ও ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতাসহ সুবিধাবঞ্চিত মানুষজন।

মহিপুর তিস্তা সড়ক সেতু সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা সামছুল ইসলাম বলেন,  ‘সড়ক সংস্কারের নামে শুধু টাকার শ্রাদ্ধই করা হচ্ছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বারবার সড়ক দেবে যাচ্ছে আর দফায় দফায় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে যান চলাচল। ফলে বুড়িমারী স্থলবন্দরসহ রংপুর-লালমনিরহাটের সংযোগ স্থাপনে তিস্তা নদীর ওপর ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু ও সড়ক নির্মাণ হলেও তা কোনো কাজে আসছে না।’  

ভারী যানবাহনে বাধা

বাস ও ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতাসহ রংপুর-লালমনিরহাট জেলার বাসিন্দারা সেতু দিয়ে ভারি যান চলাচলে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে থাকা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে নিম্নমানের কাজ হওয়ারও অভিযোগ তুলছেন। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, পাথরবাহী ভারি যানবাহন চলাচলের উপযোগী করে এই আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়নি, পরিকল্পনায় ভুল ছিল।

বুড়িমারী স্থলবন্দরসহ লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তিস্তা নদীর ওপর সেতুটি নির্মাণ করা হয়। সেতুটি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা এলাকার সঙ্গে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর এলাকাকে সড়কপথে যুক্ত করেছে। ৮৫০ মিটার দৈর্ঘ্য মূল সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১৩১ কোটি টাকা। এটি নির্মাণ করেছে ডাব্লি¬উ এমসিজি-নাভানা গ্রুপের নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।

এছাড়া কালীগঞ্জের কাকিনা হতে গঙ্গাচড়ার মহিপুর ঘাট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের ব্যয় ধরা হয় ১৩ কোটি টাকা এবং ওই সংযোগ সড়কে তিনটি কালভার্ট ও দুটি ছোট সেতুর নির্মাণ ব্যয় নির্ধারণ করা হয় প্রায় ৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোট ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দ্বিতীয় তিস্তা সেতুটি চলাচলের জন্য উদ্বোধন করেন। পরে সেতুটির নামকরণ করা হয় শেখ হাসিনা গঙ্গাচড়া সেতু। যদিও নাজুক সড়কের কারণে চার বছর ভারি যান চলাচল করতে দেওয়া হয়নি। দু’বছর আগে উন্মুক্ত করা হলেও সড়কটি চাপ নিতে না পারায় দফায় দফায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সেতুপারের বাসিন্দা ও গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউপি সদস্য রমজান আলী বলেন,  ‘দুই বছরে চার দফায় যান চলাচল বন্ধ রাখা মানেই দুর্নীতির মাধ্যমে দুর্বল সেতু ও সড়ক তৈরি করা হয়েছে। এজন্য এলজিইডি, ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টদের শাস্তি হওয়া উচিত।’

ফাইল ছবি

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্র জানায়, রংপুরের বুড়িরহাট থেকে গঙ্গাচড়ার শেষ প্রান্ত সিরাজুল মার্কেট পর্যন্ত সংযোগ সড়কের (আঞ্চলিক মহাসড়ক) প্রায় ১১ কিলোমিটার অংশের সংস্কারসহ বর্ধিতকরণের কাজ ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শেষ হয়েছে গত মার্চ মাসে। কাজটি যৌথভাবে করেছে মেসার্স খায়রুল কবির রানা, কে কে আর লিমিটেড ও বরেন্দ্র লিমিটেড নামের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একই সময়ে লালমনিরহাট অংশের সিরাজুল মার্কেট থেকে কাকিনা পর্যন্ত ৩ কোটি ৫৩ লাখ ব্যয়ে সড়ক সংস্কারের কাজ করেছে শাহাদাত এন্টারপ্রাইজ। তবে ছয় মাসের মাথায় সড়কের পাশের মাটি ও বিছানো ইট দেবে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেতুর উত্তর প্রান্তে লালমনিরহাটের রুদ্রেশ্বর এলাকায় সংযোগ সড়কে আড়াআড়িভাবে লোহার পাইপ দিয়ে তৈরি একটি প্রতিবন্ধক দেওয়া হয়েছে। এতে ভারী যান চলাচল করতে না পারলেও পিকআপ, কার, মাইক্রোবাস কোনোরকমে চলাচল করছে। এই সড়কে প্রতিদিন ছোট-বড় সাড়ে তিন হাজারের বেশি মালবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন যান চলাচলের পাশাপাশি লালমনিরহাট থেকে রংপুর শহরে চিকিৎসাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে আসা-যাওয়া করে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ।

আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, বুড়িমারী স্থলবন্দর থেকে দ্বিতীয় তিস্তা সেতু হয়ে রংপুরের দুরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। সেখানে এই সড়ক বন্ধ হওয়ায় আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যের ট্রাক আবারও লালমনিহাট জেলা সদর ঘুরে ১৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। এতে ৫০ কিলোমিটার পথ বেশি হওয়ায় সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে।

এদিকে প্রায় প্রতিদিনই ওই সেতু সড়কে যান চলাচলের দাবিতে আন্দোলন করছে বুড়িমারী স্থলবন্দরসহ পাটগ্রাম, কালীগঞ্জ ও লালমনিরহাটের বিভিন্ন উপজেলার বাস ও ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতিসহ ভূক্তভোগি সাধারণ মানুষ। ইতোমধ্যে যান চলাচলে সড়ক খুলে দাবি জানিয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে স্মাকলিপিও দিয়েছে তারা। পাটগ্রাম ট্রাক মালিক ও শ্রমিক সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তা বলেন, বুড়িমারী স্থলবন্দর থেকে ওই সেতু সড়কে যেখানে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা ভাড়া, সেখানে লালমনিরহাট হয়ে রংপুর আসতে ১৮ হাজার টাকার বেশি খরচ পড়ে। এছাড়া সময়ও লাগে দ্বিগুন। অবিলম্বে দ্বিতীয় তিস্তা সেতু সড়ক খুলে দেওয়ার দাবি জানান তারা।

রংপুর চেম্বারের পরিচালক ও আমদানিকারক মনজুর আহমেদ বলেন, সঠিক পরিকল্পনা না করে আঞ্চলিক মহাসড়কে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করা হল, যা অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। এর ফলে সেতুটি নির্মাণের উদ্দেশ্যই ভেস্তে গেছে।

এ ব্যাপারে এলজিইডি লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী কাওছার আলম বলেন, আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনায় ভুল ছিল। চলাচলের উপযোগী না করা পর্যন্ত এই প্রতিবন্ধক রাখতে হবে। না হলে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে সড়ক পুরোদমে ভেঙে পড়বে।

রংপুর এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুসা বলেন, পাথরবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করায় সড়কটি চাপ নিতে পারছে না। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে