বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ সাগর গাজী পটুয়াখালীর একমাত্র এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সাগর উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৩.৯২ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তার ফলাফল জানার পর পরিবার, সহপাঠী ও স্বজনদের মাঝে তাকে হারানোর কষ্ট বেড়ে গেছে। সাগরের ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে সংসারের অভাব অনটন ঘুচিয়ে মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবেন। সাগরকে হারিয়ে এখন শোকের সাগরে ভাসছে অসহায় এই পরিবারটি।

বুধবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া বাজার এলাকায় সাগরের নিজ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়,  বাড়িতে ঢোকার পথে রাস্তার পাশেই সাগরের কবর। কবরের পাশেই পত পত করে উড়ছে একটি জাতীয় পতাকা। আর সেখানেই দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন শহীদ সাগরের মা শাহিদা বেগম (৪৬)।  

শাহিদা বেগম বলেন, ‘আজ আমার ছেলে কত খুশি হইতো রেজাল্ট পেয়ে। মাঝেমধ্যেই বলতো মা আমার পড়াশোনা শেষে ইঞ্জিনিয়ার হইয়া তোমাদের শান্তিতে রাখব, ঘর-দরজা কইরা দিব। আমার সেই আশা তো আর পূরণ হইলো না। আমারে তো রাস্তায় পাগল বানাইয়া থুইয়া গেছে। কাল থেকে কলিজার মধ্যে কেমন করছে তা বোঝানো সম্ভব না।’

সাগরের বাবা সিরাজুল গাজী বলেন, ‘আমার তো সব শ্যাষ, ছেলেডা সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো। কারও সাথে ও খারাপ কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমার ছেলে কইতো বড় হইয়া ইঞ্জিনিয়ার হইবে। আমগো ঘর উঠাইয়া দেবে। এখন তো ওর রেজাল্ট বাইর হইছে। ও বাইচা থাকলে কত আনন্দ হইতো।’

কবরের পাশে পতাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সাগরের মেজো ভাই মো. শাওন গাজী জানান, তিন ভাইয়ের মধ্যে সাগর সবার ছোট। এসএসসি পরীক্ষার পর সাগর তার বড় ভাই মো. সুজন গাজীর কাছে ঢাকার উত্তরাতে থাকতেন। সেখানে থেকেই সাগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বিজয় মিছিলে নিয়ে জসীমউদ্দিন রোডে গেলে সাগরের মাথায় গুলি করে পুলিশ। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় সে। মৃত্যুর আগে ৪ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রুদ্র মাহমুদ নামে সাগরের ব্যক্তিগত আইডিতে মৃত্যুর পর তার কবরের পাশে একটা পতাকা টানানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটা পোস্ট করেন তিনি। পোস্টটিতে ‘আজ যদি আমি মারা যাই, বিজয়ের পর আমার কবরে একটা পতাকা দিয়েন’ লেখা ছিল। তাই সাগরের মরদেহ দাফনের পর থেকে তার কবরের পাশে একটি জাতীয় পতাকা দেওয়া হয়েছে।

সাগর গাজীর প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে গিয়ে দেখা যায়, দেয়ালে আঁকা হয়েছে গ্রাফিতি। যাতে লেখা হয়েছে ‘চালাও গুলি, যদি আমার রক্তে এ দেশে স্বাধীন হয়, সেই নতুন স্বাধীন দেশে আমি হয়ে থাকবো সকলের কাছে স্মৃতি।’ 

এদিকে ১৫ অক্টোবর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সাগরের ফলাফল জানতে পেরে কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা খুশি। তবে সাগরের এভাবে চলে যাওয়ায় এই খুশি বিষাদে রুপ নিয়েছে। সাগরের স্মৃতি মনে করে কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন শিক্ষক ও সহপাঠীরা।

কলেজের জীব বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক গোমাল ওলিউর রহমান বলেন, আমরা গর্বিত। কারণ সাগর একটা গ্রামের ছেলে হয়েও দেশের জন্য এমন মহৎ চিন্তা করে শহীদ হয়েছে। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আজকে আমরা আনন্দিত এই কারণে যে, সে পাস করেছে। অন্যদিকে আমরা ব্যথিত হয়েছি, কারণ ফলাফলের পর সকল শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকলেও সাগর গাজী আমাদের মাঝে নেই। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করবো যাতে এই অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ায়। 

আরএআর