ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন অবৈধভাবে ভারতে পালিয়ে যান।

এরপর তাকে কলকাতার মারকুইস স্ট্রিটের একটি ফার্মেসিতে দেখা গেছে। গতকাল রোববার (১৩ অক্টোবর) রাত থেকে এমন একটি ভিডিও ও বেশকিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। 

রোববার সেজান মাহমুদ নামে কুষ্টিয়ার স্থানীয় এক যুবক বেশ কিছু ছবিসহ ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে লিখেন, ‘কুষ্টিয়া ২ আসনের সাবেক আওয়ামী লীগের এমপি কামারুল আরেফিন (ফাটাকেস্ট)। কলকাতায় আমার হোটেলের সামনে একটি ওষুধের দোকানে দেখা হলে আমি যখন ভিডিও করতেছিলাম বুঝতে পেরে ওই এলাকা দ্রুত ত্যাগ করে। বেচারাকে খুব অসহায় মনে হইতেছিল। একসময়ের খুব প্রভাবশালী নেতা যে হাসানুল হক ইনুকে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে হারিয়েছে।’

এদিকে তার দেশত্যাগের বিষয়টিতে ক্ষোভ জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা বলছেন, সরকার পতনের পর কামারুল আরেফিন দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে তার কয়েকজন সহযোগীসহ ভারতে পালিয়ে যান। তারা পালিয়ে যাওয়ায় প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। হত্যা, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজী, দখলদারি, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে ও তার সহযোগীদের দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানাচ্ছি। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনের সাবেক এমপি কামারুল আরেফিন অনিয়ম দুর্নীতির ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশ-বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তিনি কুষ্টিয়ায় টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসায়, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, নদীর জায়গায় মাছ চাষ ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করেছেন সন্ত্রাসী বাহিনীর এই গডফাদার। আমরা তাদের বিচার চাই। তাদের সকল অপরাধ সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তাদের অত্যাচারে অসংখ্য মানুষ ঘরছাড়া, অনেক মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি।

জানা গেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবরে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষুব্ধ জনতার ঢল নামে। আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে। এ সময় দুর্বৃত্তরা কুষ্টিয়া মডেল থানা, শহরের পিটিআই রোডের হানিফে বাড়ি, হানিফ ভাই কুষ্টিয়া সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার বাড়ি ও মিরপুর ভেড়ামারার সাবেক এমপি কামারুল আরেফিনের বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এছাড়া জেলা ও থানা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কার্যালয়, বিভিন্ন নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা, ভাংচুর লুটপাট করা হয়।  

ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পরই এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছে কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতারা। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের পাওয়া যায়নি। 

কামারুল ২০১১ সালে সদরপুর ইউনিয়ন থেকে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে ইউপি চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে জয়ী হন। ২০১৮ সালে এসেও একই পদে জয়ী হন তিনি। তিনি বিভিন্ন সময়ে মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনে অংশ নিতে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন পদত্যাগ করেছিলেন। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র থেকে কুষ্টিয়া-২ আসনে ইনুকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন কামারুল আরেফিন।

কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব খন্দকার তসলিম উদ্দিন নিশাত ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতা কামারুল আরেফিনকে ভারতে ঘুরতে দেখা গেছে। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি। দেশে এনে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী অবৈধভাবে ভারতে পালিয়েছে। অপরাধীদের আশ্রয় না দেওয়ার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে যেসব অপরাধীরা দেশের বাইরে পালিয়েছে। তাদেরকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। সত্যতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৪৭ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব মুর্শেদ রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পালানোর সুযোগ নেই। অবৈধভাবে যাতে কেউ সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে সেজন্য ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গত কয়েকদিন আগে তিনজন সিমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করলে তাদেরকে আমরা আটক করি। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

প্রসঙ্গত, কুষ্টিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে মাথায় গুলি করে বাবলু ফারাজী (৫৮) নামে এক হকারকে হত্যা মামলায় কামারুল আরেফিনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে নির্দেশদাতারা আসামি করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট নিহত বাবলুর ছেলে সুজন মাহমুদ বাদী হয়ে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদা সুলতানার আদালতে মামলাটি করেন। 

এই মামলায় কুষ্টিয়ার সদ্য সাবেক তিন সংসদ সদস্য, কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পলাশ কান্তি নাথ, কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি মাহফুজুল হকসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিসহ মোট ১২৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ৪০/৫০ জনকে।

রাজু আহমেদ/আরকে