চারিদিকে উত্তাল মেঘনা তেতুলিয়া ও বঙ্গোপসাগর ঘেরা দেশের একমাত্র দ্বীপজেলা হচ্ছে ভোলা। এ জেলার প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী খাবার মহিষের টক দই। স্থানীয়রা এ জনপ্রিয় খাবারকে মইষা দই নামেই চেনেন।

মেঘনা ও তেতুঁলিয়ার বুকে গড়ে ওঠা ছোট-বড় প্রায় ৩২টি চরে ১ লাখ ২৪ হাজারেরও বেশি মহিষ লালনপালন করেন বাতানিরা (খামারিরা)।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে, ভোলার ৭ উপজেলার মহিষের বাতানগুলো থেকে প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হয় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ টন। মহিষের দই তৈরির জন্য ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগ দুধ সংগ্রহ করেন এসব চর থেকেই।

সম্প্রতি জিওগ্রাফিকাল আইডেনটিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের ৫৫টি জিআই পণ্যের মধ্যে ২৯ নম্বর শ্রেণীতে ব্রান্ডিং পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দ্বীপজেলার ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মহিষের দুধের কাঁচা টক দধি ‘মইষা দই’। এখন শুধু অপেক্ষা আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) এর চূড়ান্ত সনদের। এ সনদ পেলে মিলবে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি। এতে আনন্দিত এ জেলার সর্বস্তরের মানুষ।

এ জেলায় প্রথম চর জাগে ১২২০ সালের দিকে। ১৩৩৫ সালে সেখানে বসতি শুরু হলে তার নামকরণ করা হয় দক্ষিণ শাহবাজপুর। বর্তমানে সেটিই ভোলা নামে পরিচিত। তখন থেকেই চরে এখানকার স্থানীয়রা মহিষ পালন শুরু করেন এবং মহিষের দুধ থেকে কাঁচা দই উৎপাদন করা হয়। এভাবেই দিনে দিনে মহিষের দুধের কাচা দধির চাহিদা বাড়তে থাকে। ভোলার গণ্ডি ছাড়িয়ে বর্তমানে এটি দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

বাতানিরা ও গোয়ালরা প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মণে মণে মহিষের দুধ নিয়ে আসেন বিভিন্ন বাজারে। বাজার থেকে দই ব্যবসায়ীরা তাদের প্রয়োজনমতো দুধ কেনেন। এরপর বিভিন্ন মাপের মাটির টালিতে দুধ বসিয়ে দই তৈরি করে বিক্রি করেন তারা।

এখানকার সামাজিক, পারিবারিক ও ঘরোয়া ভোজে মইষা দই না থাকলে সে আয়োজন পূর্ণতা পায় না। দই ভাত, মুড়ি, চিড়ার সঙ্গে মিশিয়ে গুড় ও চিনি দিয়েও খাওয়া যায়। এছাড়াও খাবার হজমে সহায়তা করায় দেশজুড়ে ভোলার মৈষা দইয়ের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।

প্রায় ৩ যুগ ধরে ভোলা জেলা শহরে মহিষের দই বিক্রি করা সেলিম নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, গরুর দুধের চেয়েও মহিষের দুধ বেশি ঘন। মাটির টালিতে (পাত্রে) দই পাতলে সে টালি দুধের পানি শুষে নেয়। গোয়াল এবং বাতানিরা প্রতিদিন দুপুরে চর থেকে আমাদের মহিষের দুধ এনে দেন। এরপর দুধ ভালো করে ছেঁকে বিভিন্ন সাইজের মাটির পাত্রে দুধ ঢেলে রেখে দেই। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পরে দুধ জমে জমে দই হয়ে খাওয়ার উপযোগী হয়। পরে ফ্রিজে রেখে বিক্রি করি। প্রতি কেজি দই বিক্রি করি ২০০ থেকে ২২০ টাকায়।

তবে সেখানে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন খামারিরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মহিষ খামারি জানান, ভোলার চরগুলো সবসময় একদল লাঠিঁয়াল বাহিনীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। তারা প্রতি বছরের জন্য নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করে খামারিদের কাছে চরের ঘাস বিক্রি করেন। এতে চরে মহিষ অবাধে বিরচন করে কাঁচা ঘাস খেতে পারে না এবং প্রায়ই চরে মহিষের খাবার সংকট দেখা দেয়। ফলে দুধের পরিমাণ কমে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহিষ নিখোঁজ হয়। মহিষের নিরাপত্তায় চরে কিল্লা নেই। এতে দুর্যোগের সময় মহিষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ভোলার সচেতন মহল বলছে, ভোলার ঐতিহ্যবাহী মইষা দইয়ের মান ধরে রাখতে হলে প্রশাসনকে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ে কার্যকর উদ্যোগসহ চরে মহিষের অবাধ বিচরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খাঁন জানান, দেশের সবচেয়ে বেশি মহিষ পালন ও দুধ উৎপাদন হয় ভোলা জেলায়। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ভোলার মহিষের দুধের দধি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। চরাঞ্চলে অনেক সময় ঘাঁসের অপর্যাপ্ততা থাকার কারণে মহিষগুলো অপুষ্টিতে ভোগে এবং দুধ উৎপাদন কমে যায়। এ জন্য চরাঞ্চলে আধুনিক ঘাস চাষের জন্য খামারিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে মহিষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে ভেক্সিনেশনও করা হচ্ছে।

ভোলা জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বলেন, ভোলার ঐতিহ্যবাহী মহিষের দুধের কাঁচা দই এখন জিআই পণ্য। এটি ভোলার মানুষের জন্য গর্বের বিষয়। ভোলার ধান সুপারি ও ইলিশের গোলার সঙ্গে এবার মহিষের দইও জিআই পণ্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে। এটি আমাদের আরও সমৃদ্ধ করবে বলে আমি মনে করি।

তিনি আরও জানান, ভোলায় মহিষের বাতান বৃদ্ধি ও মহিষের দুধ উৎপাদন আরও বাড়ানোর পাশাপাশি ভোলা জেলায় মহিষ পালনের জন্য নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য আমরা কাজ করছি এবং তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

এফআরএস