রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। তাদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয়ভাবে এলাকায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে বেশিরভাগ রোগী ঢাকায় গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। গেল সাত দিনে রাজশাহী বিভাগের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোগী বেশি ভর্তি হয়েছেন। আর উপজেলার মধ্যে চারঘাটের রোগী বেশি দেখা যাচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, এ বছর স্থানীয়ভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। বিগত বছরগুলোতে আক্রান্ত রোগীদের ভ্রমণের রেকর্ড ছিল। কিন্তু এ বছর নেই। তাতে ধারণা করা হচ্ছে স্থানীয়ভাবে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত রামেক হাসপাতালে ৩৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৪৩ জন রোগী স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এ বছর রাজশাহী নগরের তুলনায় উপজেলাগুলোতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি।

আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের গেল সাত দিনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রোগী ১৫ জন ও চারঘাট উপজেলা থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১০ জন। রাজশাহী বিভাগ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও উপজেলায় চারঘাটে ডেঙ্গু রোগীর সখ্যা বেশি। গত বছরও রাজশাহী জেলায় চারঘাট ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে পরিচিতি পায়। এই উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৫০ বছর বয়সী মনিরুল ইসলাম। তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ১০ অক্টোবর রামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার ছেলে মো. বিশাল জানান, তার জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপরে পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তিনি বৃহস্পতিবার থেকে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে সুস্থ। 

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার কালুহাটি গ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন মোসা. আম্বিয়া বেগম (৬০)। তিনি প্রথমে পুঠিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। সেখানে তিনদিন চিকিৎসাধীন থাকার পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ৯ অক্টোবর তিনি রামেক হাসপাতালে ভর্তি হন।

আম্বিয়া বেগমের ছেলে শাহিনুল ইসলাম শহীদ বলেন, আমার মায়ের শরীরে জ্বর ছাড়াও অন্য সমস্যা ছিল। তিনি রামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন সুস্থ আছেন। তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আগে নিজ বাড়ি থেকে কোথাও যায়নি। ফলে ধারণা করা হচ্ছে তিনি বাড়িতে মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

চারঘাট উপজেলার বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রহমানের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেনি। 

রামেক হাসপাতালের গেল সাত দিনের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- ৬ অক্টোবর রোগী ছিল ৪৩ জন। সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬ জনে। এসময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৫১ জন রোগী। এছাড়া সুস্থ হয়ে ছুটি পেয়েছেন ৭৫ জন। গেল সাত দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো রোগীর মৃত্যু না হলেও চলতি মৌসুমে রামেক হাসপাতালে তিনজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

জানা গেছে, রামেক হাসপাতালে রাজশাহীর সব জেলার রোগীরা চিকৎসা সেবা নিয়ে থাকেন। এ বছর ডেঙ্গুতে কমবেশি রাজশাহীর সব উপজেলার মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতলটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন। শুধু উপজেলা নয়, বিভাগের অন্যসব জেলার রোগীরাও চিকিৎসা নিয়েছেন হাসপাতালটিতে।

রাজশাহী বিভাগের হিসেবে গেল সাত দিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নওগাঁ জেলার ১০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন রামেক হাপসাতালে। পাবনা জেলা থেকে ১১ জন, সিরাজগঞ্জ থেকে ৩ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১৫ জন, রাজশাহী জেলা থেকে ৪৯ জন ও নাটোর জেলা থেকে ৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। সেই হিসেবে রাজশাহীর বাসিন্দাদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। যদিও বিশ্লেষণে দেখা গেছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ঢাকায় আক্রান্ত হয়েছেন।

রাজশাহী জেলার হিসেবে গেল সাত দিন বাঘা উপজেলার ৮ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন রামেক হাসপাতালে। মোহনপুরের ৪ জন, চারঘাটের ১০ জন, পুঠিয়ার ৮ জন, বাগমারার ৫ জন, পবার ৫ জন, গোদাগাড়ীর ৭ জন, দুর্গাপুরের ২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হিসেবে জেলার সব উপজেলার মধ্যে চারঘাটে বেশি। আক্রান্তের মধ্যে বেশির ভাগ স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

রামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার তথ্য দিয়েছে। তাদের দেওয়া সাত দিনের তথ্য বিশ্লেষন করে দেখা গেছে-গত ৬ অক্টোবর হাসপাতালটিতে নতুন ৬ জনসহ মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল ৪৩ জন। এদিন সুস্থ হয়ে ছুটি পেয়েছেন ৫ জন রোগী। গত ৮ অক্টোবর ডেঙ্গু রোগী ছিল ৩৯ জন। এদিন নতুন করে ভর্তি হয় ১৮ জন। ছুটি পেয়েছে ৬ জন রোগী। ৯ অক্টোবর নতুন করে আরও ১৬ জন ভর্তি হলে মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১ জনে। এদিন ছুটি পেয়েছে ১০জন রোগী।

তার পরের দিন ১০ অক্টোবর ২৪ ঘণ্টার হিসেবে হাসপাতালটিতে মোট ডেঙ্গু রোগী ছিল ৫৭ জন। এদিন নতুন করে রোগী ভর্তি হয় ৫ জন। ছুটি পেয়েছে ৯ জন রোগী। ১১ অক্টোবর হাসপাতালটিতে মোট ডেঙ্গু রোগী ছিল ৫৫ জন। এদিন নতুন করে রোগী ভর্তি হয় ২০ জন। ছুটি পেয়েছে ২১জন রোগী। ১২ অক্টোবর মোট ডেঙ্গু রোগী ছিল ৫২ জন। এদিন নতুন করে ভর্তি হয় ৯ জন। ছুটি পেয়েছে ৫জন রোগী। সর্বশেষ রোববার (১৩ অক্টোবর) ২৪ ঘণ্টার হিসেবে হাসপাতালটিতে মোট ডেঙ্গু রোগী ছিল ৫৬ জন। এদিন নতুন করে রোগী ভর্তি হয় ৯ জন। ছুটি পেয়েছে ১৭ জন রোগী।

হাসপাতালের হিসেবে চলতি ডেঙ্গু মৌসুমে মোট ৩৭৯ রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩২৮ জন। এর মধ্যে রাজশাহীতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা ছিল ২৪৩ জন। সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর হিসেবে অনুযায়ী হাসপাতালটিতে মারা গেছে ৩ জন ডেঙ্গু রোগী।

এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. শংকর কে বিশ্বাস বলেন, এ বছর বেশি মানুষ স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত বেশি হয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীগুলোর ঢাকায় ভ্রমণের রেকর্ড ছিল। কিন্তু এ বছর নেই। তাতে ধারণা করা যাচ্ছে স্থানীয়ভাবে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ বছর রাজশাহী নগরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী কম। বেশি রোগী উপজেলাগুলোতে।

তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে রাজশাহী জেলার চারঘাট, বাঘা ও পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থেকে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হত। কারণ হিসেবে আমরা মনে করেছি সচেতনতার অভাব ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ঘাটতি রয়েছে। তবে এ বছর রোগীর চাপ কম। প্রতিদিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে। এ বছর রামেক হাসপাতালে ৩৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এরমধ্যে স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছে ২৪৩ জন।

রাজশাহীর সিভিল সার্জন আবু সাঈদ মো. ফারুক বলেন, গত বছর রাজশাহী জেলার মধ্যে চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ছিল। এবার চারঘাট উপজেলায় বেশি। আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে জানিয়েছে রোগীর চিকিৎসার জন্য যা যা করা লাগে তারা করবে। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর রাজশাহীতে ডেঙ্গু রোগী সংখ্যা কম। 

শাহিনুল আশিক/আরকে