রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ার বাহিরচর এলাকায় জেলেদের নৌকা বাঁধা। বেলা সাড়ে ১১টা। কয়েকজন জেলে সেখানে মাছ ধরতে নদীতে যাওয়ার অপেক্ষা করছেন। বাকি জেলেরা নদীতে মাছ শিকার করে পাড়ে এসেছেন। সব মিলে অর্ধশত জেলে সেখানে। জানতে চাওয়া হয় জালে কেমন ইলিশ ধরা পড়ছে। উত্তরে কয়েকজন জেলে জানান, পদ্মায় ইলিশের আকাল চলছে। আগে যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ জালে আটকা পড়ত, সেখানে জালে এখন তেমন ইলিশ ধরা পড়ে না। ইলিশ এখন সোনার হরিণ জেলেদের কাছে।

জেলেরা বলেন, একসময় প্রতি ফেলা জালে দুই থেকে তিন মণ করে ইলিশ পাওয়া যেত। জাল তুলতে কষ্ট হতো। অথচ এখন সারা দিনে খুবই কম ইলিশ পাওয়া যায়। ভাগ্যচক্রে সারা দিনে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ কেজি ইলিশ পাওয়া যায়। তবে বেশিরভাগ জেলে ৩-৪ কেজি করে ইলিশ পেয়ে থাকেন। অনেক জেলে খালি হাতে বাড়িতে আসেন। বর্তমানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পদ্মার জেলেদের।

অপরদিকে বাজারে ইলিশের চড়া দাম। নিম্নবিত্তরা তো আগে থেকেই খেতে পারেন না ইলিশ, আবার এখন মধ্যবিত্তরের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে ইলিশ। খেতে মন চাইলেও মধ্যবিত্তদের ইলিশ খেতে গেলে ভাবতে হচ্ছে ১০ বার। তবে ক্রেতারা বলছেন, সুষ্ঠুভাবে বাজার তদারকি ও মনিটরিং করলে কিছুটা স্থিতিশীল থাকবে ইলিশের দাম।যে মাছ চাষ করতে হয় না, কোন খরচ ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে যে মাছ বেড়ে ওঠে সেই মাছের ধরাছোঁয়ার বাইরে হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।

দৌলতদিয়া ইউনিয়নের প্রদীপ হালদার (৬২) নামে এক জেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাছ ধরা আমার বাপ-দাদার পেশা। বর্তমানে এ পেশা লাভজনক না হলেও ধরে রেখেছি জীবিকার তাগিদে। আমার মাছ ধরার বয়স ৩০ বছরের কম না। ১৯৯০ সালের পর থেকে এই দৌলতদিয়ার পদ্মায় মাছ শিকার করি। বাপ-দাদার কাছে শুনেছি ১৯৮৮ সালের বন্যার পর পদ্মায় ইলিশের আকাল শুরু হয়েছে। এরপর থেকেই ইলিশের আর সোনালী দিন ফেরেনি। তারপরও এই পৈতৃক পেশা ধরে রেখেছি। কিন্তু আমি চাই না আমার সন্তান বা পরের প্রজন্ম এই পেশায় আসুক। অনেকেই এখন এই পেশা পরিবর্তন করেছে।

তিনি আরও বলেন, মাছ যা পাই তা বিক্রি করে আমার পোষায় না। পদ্মায় মাছ শিকারে গেলে ৫/৬ জনের কমে যাওয়া যায় না। সবার দিনের একটা হাজিরা আছে। নৌকার তেল খরচ, জালের খরচ, দাদনের টাকা ইত্যাদি মিলে অনেক খরচ। কিন্তু মাছ বিক্রি করে আমরা লাভ করতে পারছি না। আবার ২২ দিন ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। এই ২২ দিন কীভাবে চলবো বুঝতে পারছি না।

রাজবাড়ী সদরের গোদার বাজার, সোনাকান্দর, উড়াকান্দা এলাকার কয়েকজন জেলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষেধ থাকবে। আমরা ইলিশ সম্পদ রক্ষায় নদীতে নামবো না। কিন্তু বাইরের জেলেরা এসে ঠিকই মাছ মেরে নিয়ে যাবে। মৎস্য বিভাগসহ প্রশাসনকে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। নদীতে অভিযান চলাকালে দেখা যায়, যেদিকে অভিযান চলে তার উল্টো দিকে জেলেরা মাছ ধরে। মৎস্য বিভাগের সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যক্তিদের আঁতাত থাকে। যারা অভিযানের তথ্য জেলেদের দিয়ে দেয়। এই বিষয়গুলো প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে।

দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী মাছের ব্যবসা করেন। মৎস্য আড়ত থেকে মাছ ক্রয় করে মুঠোফোনে অথবা অনলাইনে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই মাছগুলো বিক্রি করেন তারা। দৌলতদিয়া মৎস্য আড়ত থেকে প্রকাশ্য নিলামে মাছ ক্রয় করেন ফেরিঘাটের ব্যবসায়ী মো. চান্দু মোল্লা, সম্রাট শাহাজাহান শেখ, মো. সোহেলসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী।

দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের মাছ ব্যবসায়ী মো. চান্দু মোল্লার চাঁদনী অ্যান্ড আরিফা মৎস্য আড়তে গিয়ে দেখা যায়, বিক্রির জন্য আড়ত থেকে শুক্রবার ভোরে বেশ কয়েকটি বড় সাইজের ইলিশ কিনেছেন তিনি। চান্দুর ভাষ্য- প্রতি কেজি ইলিশের ওজন ১ কেজির সামান্য বেশি। গড়ে ২ হাজার ৩০০ টাকা কেজি দরে প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে ইলিশ কেনা হয়েছে। এগুলো বিক্রি করা হবে ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকা কেজি দরে। 

তিনি বলেন, দৌলতদিয়াতে তেমন পদ্মার ইলিশ পাওয়া যায় না। গত বুধবার ২ হাজার ২০০ টাকা, বৃহস্পতিবার ২ হাজার ১০০ টাকা দরে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে। আড়তে ৩০ থেকে ৫০ কেজির মতো ইলিশ পাওয়া যায়। তারও দাবি কোনো কোনো জেলে ১০ কেজি, কেউ ২ কেজি ইলিশ নিয়ে আড়তে আসেন।

সরেজমিনে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজবাড়ী বড় বাজারের মাছ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, খুচরা বাজারে ১ কেজি থেকে ১ কেজির বেশি সাইজের ইলিশ কেজি প্রতি ২৩০০ টাকা ২৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ৯০০ গ্রাম থেকে ১ কেজির কিছু কম ওজনের ইলিশ ২১০০ থেকে ২৩০০ টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৭০০ থেকে ২০০০ টাকা, ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ ১৪০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা কেজি, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১০০০ থেকে ১৩০০ টাকা ও ২০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ মানভেদে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

একই বাজারে পাইকারদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১ কেজি থেকে ১ কেজির ওপরের সাইজের ইলিশ বাজারে ২০০০ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। ৮০০ থেকে ১ কেজির নিচের সাইজের ইলিশ ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা, ছোট সাইজের জাটকা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। তাদের দাবি, বাজারে বড় মাছের আমদানি কম থাকায় দাম বাড়তি রয়েছে। গত সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে সব সাইজের ইলিশে কেজি প্রতি বেড়েছে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। এছাড়াও আগামী ১৩ তারিখ থেকে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ থাকায় বাজারে মাছের দাম বেশি।

রাজবাড়ী বড় বাজারের খুচরা ইলিশ মাছ ব্যবসায়ী মো. শফিউদ্দিন বলেন, চাহিদার তুলনায় বাজারে ইলিশের আমদানি কম। আবার নদীতে জেলেরা পর্যাপ্ত মাছ পাচ্ছে না। আগে যেমন নদীতে ইলিশের সয়লাব ছিল এখন নদীতে তেমন ইলিশ নেই। বর্তমানে জেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু মাছের সংখ্যা কমে গেছে। আবার জেলেরা এখন যে ধরনের সূক্ষ্ম জাল ব্যবহার করে সে জালে বালুর কণা পর্যন্ত আটকে যায়। এইসব জালে ছোট বাচ্চা ইলিশ আটকে যাওয়ার কারণে নদীতে ভরা মৌসুমে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যায় না। সরকারের উচিত অভিযানের সময় জেলে কিংবা ব্যবসায়ীদের জরিমানা না করে এই ধরনের জালগুলো ধ্বংস করা।

রাজবাড়ী বাজারের ইলিশ মাছ ব্যবসায়ী আল-আমিন ও মুক্তার বলেন, বাজারে ইলিশের আমদানি কম। তারপর আবার পূজা উপলক্ষ্যে সরকার ভারতে ইলিশ পাঠিয়েছে। একারণে বাজারে ইলিশের দাম চড়া।

বেসরকারি একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আলতাব শেখ। সকালে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন রাজবাড়ী মাছ বাজারে। প্রায় ২০ মিনিট ধরে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে ইলিশের দাম জিজ্ঞাসা করছেন। সর্বশেষ তিনি ইলিশ না কিনে কিনলেন পাঙাশ মাছ।

আলতাব শেখের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি চাকরি করি একটি এনজিওতে। অল্প বেতন। ভেবেছিলাম নিষেধাজ্ঞার আগে আজ বাজারে ইলিশের দাম কম থাকবে। কিন্তু আজও ইলিশের দাম বাড়তি। আকাশছোঁয়া দামে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের পক্ষে ইলিশ কেনা সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে একটি পাঙাশ মাছ কিনলাম। সরকারের কাছে দাবি ইলিশের দাম মধ্যবিত্তদের নাগালের মধ্যে রাখতে। যাতে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তরাও ইলিশের স্বাদ নিতে পারে।

রাজবাড়ী জেলার মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও সদটলর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোস্তফা আল রাজীব বলেন, ইলিশ এখন তুলনামূলক কম পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ পদ্মায় ইলিশ আসতে পারে না। নদীতে বিভিন্ন স্থানে চর পড়েছে। ইলিশের যে মাইগ্রেটরি চ্যানেল ছিল, সেই চ্যানেল বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে এখন ইলিশের আধিক্য কমে গেছে। কেন পদ্মায় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না, তার কারণ খুঁজে বের করতে আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি পদ্মায় ইলিশের সুদিন আসবে। 

তিনি আরও বলেন, আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান চলবে। এই ২২ দিনে ইলিশ ধরা, সংরক্ষণ, পরিবহন সবকিছুই নিষিদ্ধ থাকবে। আমরা জেলে ভাইদের উদ্দেশ্যে একটা ম্যাসেজ দিতে চাই, ইলিশ একসময় শূন্যের কোঠায় চলে গিয়েছিল। সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে একটি হলো ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এই ২২ দিন নিষেধাজ্ঞার কারণেই মা ইলিশ নদীতে এসে ডিম ছাড়তে পারে, সেখান থেকেই আমাদের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা বিশ্বের ১১টি দেশের মধ্যে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম। জেলেদের সেক্রিফাইসের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। তাই জেলেদের প্রতি আমার অনুরোধ, সামনের এই ২২ দিন তারা মা ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকবেন। ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ করে দেবেন। তারা এই ২২ দিন সেক্রিফাইস করলে আগামীতে নদীতে ইলিশ ভরপুর হয়ে যাবে। কিন্তু যেসব জেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে ইলিশ ধরবে আমরা তাদের কঠোরহস্তে দমন করব, এমনকি তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করব। যাতে তারা পরবর্তীতে সরকারি প্রণোদনা না পান।

মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/পিএইচ