বর্তমানে বাজারে ইলিশের দাম এতটাই বেড়েছে, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, মধ্যবিত্তের জন্যও ইলিশ কেনা এখন দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইলিশ মাছ সাধারণত উৎসবের সময়ে এবং বিশেষ উপলক্ষ্যে স্থানীয় মানুষের খাদ্য তালিকায় দেখা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক ইলিশের দাম ঊর্ধ্বমুখী এবং সরবরাহ সংকটের কারণে এ মাছটি এখন আর সাধারণ মানুষের পাতে তেমন দেখা যায় না। একসময় যেখানে ইলিশ মাছ সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য ছিল, সেখানে এখন এটি যেন বিলাসিতার একটি বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

অথচ ইলিশ দেশের ঐতিহ্যবাহী মাছ। তবে কী এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ? কেন সাধারণ মানুষ আজ ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত? ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বেশ কিছু চিত্র।

ইলিশের সরবরাহ সংকট

বাংলাদেশে ইলিশের প্রাপ্তিস্থান মূলত পদ্মা, মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল। তবে উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও দেশের উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে বিগত কয়েক বছর ধরে ইলিশের দেখা মিলছে অল্প পরিমাণে।‌ ইলিশের মৌসুম শুরু হলেও জেলেদের জালে আশানুরূপ পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে‌ প্রজননস্থলগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার ফলে ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাজারের দামে।

বাজারে মূল্যবৃদ্ধির চিত্র

গাইবান্ধা শহরের কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক কেজি সাইজের ইলিশের দাম ১৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৯০০ টাকা পর্যন্ত। ৫০০-৬০০ গ্রামের ছোট সাইজের ইলিশও ১২০০-১৩০০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। ২৫০ গ্রাম সাইজের জাটকা ইলিশ কিনতেও গুনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা। এ অবস্থায় বড় ইলিশ তো দূরের কথা সবচেয়ে ছোট ইলিশ কিনতেও পকেটে টান পড়ছে ক্রেতাদের।‌ যেখানে বছর দুয়েক আগেও হাজার টাকার মধ্যে মানসম্পন্ন ইলিশ পাওয়া যেত, সেখানে এখন দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, দাম এত বেশি, ইলিশের নাম শুনলেই এখন ভয় লাগে।

গাইবান্ধা শহরের পুরাতন বাজারে মাছ কিনতে আসা আকবর সিদ্দিক নামে এক কৃষক বলেন, ভয়ে বড় ইলিশের দাম শুনি নাই। কোনো রকম চাষাবাদ করে খাই। আমার দ্বারা এক কেজি ওজনের ইলিশ কেনা সম্ভব না। তাই দুইটা ছোট ইলিশ (জাটকা) ৩০০ টাকা দিয়ে নিলাম।

মেরিনা বেগম নামে আরেক নারী ক্রেতা বলেন, ছেলে-মেয়ে ইলিশ খেতে চায়, কিন্তু দামের কারণে কিনতে পারি না। অনেকক্ষণ ধরে বাজার ঘুরে দেখলাম ইলিশের দাম এত বেশি যেটা কল্পনাতীত। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর জন্য জাটকা কিনে নিলাম।

মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি

বাজারে ইলিশের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে একটি বড় কারণ হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি। নদী বা সমুদ্র থেকে ইলিশ সংগ্রহ করে স্থানীয় পাইকারদের কাছে বিক্রির আগে বেশকিছু মধ্যস্বত্বভোগী হাত বদল করে। এদের কারণে ইলিশের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। মাছের মৌসুমে চাহিদার কথা মাথায় রেখে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইলিশ মজুদ করে রাখে, যা সরবরাহ সংকট তৈরি করে। ফলে বাজারে স্বাভাবিক সরবরাহ না থাকায় দাম বেড়ে যায়।

গাইবান্ধা শহরের নতুন বাজারের পরেশ মৎস্য আড়তের স্বত্বাধিকারী পরেশ চন্দ্র বলেন, ইলিশ মাছের ব্যবসাটা মূলত নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকার ব্যবসায়ীরা। মাছ সরবরাহের ওপর নির্ভর করে ঢাকার ব্যবসায়ীরা দাম নির্ধারণ করে থাকেন। এ ছাড়াও দেশের মধ্যে বড় বড় মজুতদার আছে অনেক কোল্ড স্টোরেজ আছে। মাছের দাম কমে গেলে কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা মাছ মজুদ করে রাখে। যার কারণে ইলিশের দাম সারা বছরেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকে।

রপ্তানি ও বৈদেশিক চাহিদার প্রভাব

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইলিশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বিশেষ করে ভারতে দুর্গাপূজার সময় ইলিশের চাহিদা অনেক বেশি। দেশীয় বাজারের তুলনায় রপ্তানিতে বেশি লাভজনক হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ইলিশ রপ্তানির দিকে ঝুঁকছেন। এতে করে স্থানীয় বাজারে ইলিশের ঘাটতি দেখা দেয়। আর এই ঘাটতির ফলে দামও বেড়ে যায়।

গাইবান্ধা শহরের নতুন বাজারে ইলিশ মাছ কিনতে আসা জাভেদ হোসেন নামে এক সাংবাদিক বলেন, সাধারণ মানুষের পাতে ইলিশ না ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে রপ্তানি। দেশের যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হয় সে অনুযায়ী চাহিদা অনেক বেশি। দেশের চাহিদা পূরণ না হতেই ইলিশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। যার কারণে ইলিশের দামটা সবসময় বেশি থাকে। সরকারের অবশ্যই এই দিকটাতে নজর দেওয়া উচিত। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে তবেই ইলিশ মাছ রপ্তানি করা শ্রেয় বলে মনে করেন তিনি।

ইলিশ ব্যবসায়ীরা কী বলছেন

আমরা ইলিশের দাম নিজেরা বাড়াই না বরং সরবরাহ কম এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে বলে দাবি করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, পাইকারদের কাছে থেকে বেশি দামে কেনার কারণে স্থানীয় বাজারে ইলিশের দাম বেশি। গাইবান্ধার মতো অনুন্নত শহরগুলোতে বড় ইলিশের চাহিদা কম। তবে দাম কিছুটা কম হওয়ায় শতকরা ৮০ শতাংশ ক্রেতারা ছোট সাইজের (জাটকা) ইলিশ কিনে থাকেন।

গাইবান্ধা শহরের পুরাতন বাজারের ইলিশ ব্যবসায়ী শম্ভু চন্দ্র বলেন, আমি ঢাকার আব্দুল্লাহপুর থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে আসি। জেলায় বড় ইলিশের ক্রেতা একেবারে সীমিত। দাম কম হওয়ায় ছোট ইলিশের ক্রেতা রয়েছে। তবে আগের মতো ইলিশের ব্যবসাটা আর নেই। দাম বেশি হওয়ার কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় আমাদের ব্যবসাও কম হচ্ছে। ইলিশের দাম কম হলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই লাভ হয়।

গৌতম নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আমি নিজে ব্যবসা করি, আমিও বড় সাইজের ইলিশ কিনতে পারি না। ছোট ইলিশই আমাদের ভরসা। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের পক্ষে বড় ইলিশ কেনা দুঃসাধ্য ব্যাপার।

সাধারণ মানুষের মতে

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ দেশের বিভিন্ন সংকট নিয়ে আন্দোলন করা বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্য মনজুর আলম মিঠু বলেন, উত্তরাঞ্চলের মানুষ কৃষি নির্ভর। বিশেষ করে এই মুহূর্তে দিনমজুর এবং খেতমজুর মানুষদের হাতে কাজ নেই। অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষদের আয় সীমিত। সর্বোচ্চ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে তারা। এই টাকা দিয়ে সংসারের অন্যান্য খরচ করার ইলিশ কেনা সম্ভব না। যে কারণে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের পাতে ইলিশ ওঠে না।

ইলিশ মাছকে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে গেলে সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরি। বিশেষ করে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ, হাটঘাটের ইজারা বিলুপ্তিসহ আইনের কঠোর প্রয়োগ করা গেলে তবেই ইলিশ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে।

কী বলছে জেলা মৎস্য অফিস

গাইবান্ধা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধার নদ-নদী (ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনা) থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ১৪ মেট্রিক টন পাওয়া গেছে। যা গত বছর ছিল ১৭.১৭ মেট্রিক টন।

গাইবান্ধা সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মারজান সরকার বলেন, আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ইলিশের প্রজনন মৌসুম শুরু হবে। এই সময়টাতে নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। এই সময়ে জেলার মোট সাড়ে ৫ হাজার জেলে পরিবারকে ভিজিডি এবং ভিজিএফের চাল বিতরণ করা হবে। ইলিশ সম্পদ রক্ষায় যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গাইবান্ধার নদ-নদীগুলোতে বিগত কয়েক বছরের তুলনা ইলিশের উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছে। আমরা আশা করছি, এটা অব্যাহত থাকবে। সারা দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়লে ইলিশ অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া যাবে।

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং দেশের খাদ্য সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু দামের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে ইলিশ এখন সাধারণ মানুষের পাতে উঠছে না। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে এবং বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারি ও বেসরকারি উভয়পক্ষের কার্যকরী উদ্যোগ প্রয়োজন। তবেই সবার জন্য আবার ইলিশের স্বাদ উপভোগ করা সম্ভব হবে।

রিপন আকন্দ/এএমকে