দেশে আহরিত ইলিশের ৬৫ শতাংশের বেশি উৎপাদিত হয় বরিশাল বিভাগের নদ-নদীতে। নদী প্রধান এই অঞ্চলের ইলিশ সুস্বাদু। আকৃতিও অন্য অঞ্চলের চেয়ে ভালো। তবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষই চাহিদা মতো ইলিশ খেতে পারছে না। এ নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবারহ কম এবং চড়া মূল্য— এই দুই কারণে ইলিশ বঞ্চিত হচ্ছে দক্ষিণের মানুষ।

বিভাগীয় মৎস্য অফিদফতর জানিয়েছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে ইলিশের মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৮৪৫  মেট্রিক টন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৭০ হাজার ৭৬২ মেট্রিক টন ইলিশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়  ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫১২ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৭৭ মেট্রিক টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়  ৩ লাখ ৫১ হাজার ২২৩ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৭৬ মেট্রিক টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়  ৩ লাখ ৮৫ হাজার ১৪০ মেট্রিক টন ইলিশ। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ২ লাখ ২১ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২১১ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৮১ মেট্রিক টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৯৫১ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ২ লাখ ৫৮ হাজার ২২৫ মেট্রিক টন ইলিশ। 

২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয় ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ২৪ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ২৯ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৫ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৪১ হাজার ১১৯ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৫০ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯২৭ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৩০১ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৩ মেট্রিক টন। বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫১ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৭১ হাজার ৩৪২ মেট্রিক টন।  বরিশাল বিভাগে উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৪৩ মেট্রিক টন।

ঝালকাঠি কালীবাড়ী রোডের বাসিন্দা আব্দুল মজিদ বলেন, প্রায় কুড়ি বছর ধরে ঘরের বাজার আমি করি এবং ঝালকাঠির এই বাজার থেকে বাজার করি। ৬-৭ বছর আগেও বাজারে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত, তা এখন পাওয়া যায় না। আগে মৌসুমে ইলিশের বিক্রেতারা গ্রামে গ্রামে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতো। এখন ইলিশ কিনতে হলে টাকা-পয়সা নিয়ে যেমন প্রস্তুতি নিতে হয়, তেমনি বাজারে গেলেও আপনি কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাবেন না।

তিনি বলেন, আমাদের বাজারে ১০০ ক্রেতা থাকলে জাটকা নিয়ে সাকুল্যে ৩০ কেজিও ইলিশ থাকে না।

আব্দুল মজিদের আক্ষেপের সূত্র ধরে প্রশ্ন করা হয় পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার কচুবাড়িয়া গ্রামের জেলে আলম গোলদারকে। তিনি বলেন, সড়কের উন্নয়ন হওয়ায় আমাদের ইলিশ পাঠাতে সমস্যা হয় না। আগে ইলিশ ধরে আনলে পাইকারের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু পথঘাটের উন্নয়ন হওয়ায় পাইকার আসতে দেরি হলে আমরাও গাড়িতে করে বড় বাজারে নিয়ে যেতে পারি।

তিনি জানান, স্থানীয় বাজারে বিক্রি করলে কম দাম পাওয়া যায়। একটু কষ্ট করে ঢাকায় পাঠাতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যায়।

একই কথা বলেন তার প্রতিবেশী জেলে তফাজ্জেল হোসেন। তিনি বলেন, মঠবাড়িয়ায় যে ইলিশটা এক হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারব, সেটি ঢাকায় পাঠাতে পারলে আরও ৪০০-৫০০ টাকা বেশি পাওয়া যায়। পরিবহন ও বরফ খরচ বাদ দিয়ে ১০০-২০০ টাকা বাড়তি আসে। যে কারণে এই এলাকার যারা মাছ ধরেন অনেকেই এলাকার বাজারে মাছ বিক্রি করেন না।

বরিশাল পোর্ট রোডের আড়তদার মো. দুলাল বলেন, মৌসুমে প্রতিদিন ২০-৩০টি ট্রলার ইলিশ নিয়ে আসতো ৫-৭ বছর আগেও। তখন দক্ষিণাঞ্চলের মোকাম বলতে বরিশালকে বোঝাতো। সড়ক পথ ভালো না থাকায় নদী পথেই পরিবহন হতো। দিনে অন্তত ১ কোটি টাকার ইলিশ বিক্রি হতো। কিন্তু গত সরকারের সময় এই অঞ্চলের সড়ক পথ ভালো হওয়ায় এখন আর বরিশাল মোকামে কারো আসতে হয় না। যার যার এলাকায় থেকে মাছ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠায়।

আরেক ব্যবসায়ী বাদশা বলেন, স্থানীয় বাজারগুলোতে ইলিশ পাওয়া যাবে না কারণ পদ্মা সেতু হওয়ার পরে উপকূল থেকে সরাসরি ঢাকায় মাছ পাঠায়। এজন্য আমাদের বাজারে মাছ আসা কমে গেছে। বরিশালে যা আসে এর অধিকাংশ ভোলা থেকে। ভোলায় সড়ক পথ হয়ে গেলে সেই মাছও আসবে না।

জানা গেছে, এক দশক আগে বিভাগের ৬ জেলায় সব মিলিয়ে ৩০টিরও কম ইলিশের আড়ত ছিল, যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা করতো। কিন্তু বর্তমানে যাতায়াত ব্যবস্থার অভূতপূর্ণ উন্নয়ন হওয়ায় দুই শতাধিক আড়ত ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে বরিশাল পোর্টরোড, কলাপাড়ার আলীপুর-মহিপুর, পাথরঘাটার বিএফডিসি, ভোলা বাজারের মৎস্য অবতরকেন্দ্র উল্লেখযোগ্য।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক জানান, তার নিজের মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে। কয়েক বছর আগেও তিনি আলীপুর-মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ব্যবসা করতেন।

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সাগর থেকে মাছ নিয়ে ফিরলে ছোট ট্রাকে সব মাছ ঢাকার কারওয়ান বাজারে পাঠাই। সেখানে আমার আত্মীয় এক ব্যবসায়ী আছে। ওর মাধ্যমে ব্যবসা করি। এতে স্থানীয় বাজারের চেয়ে লাভ বেশি আসে।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত) রিপন কান্তি ঘোষ জানান, সড়কের উন্নয়ন হওয়ায় বিক্রেতারা সহজেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বড় বাজারে ইলিশ নিয়ে যেতে পারছেন। তাছাড়া দিনে দিনে ইলিশের চাহিদা বাড়ছে। এজন্য দক্ষিণাঞ্চলে আহরিত মাছ পরিবহন করে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ায় এদিকের বাজারে কিছুটা কম উঠছে।

আরএআর