ইলিশ শুধু সুস্বাদু মাছই নয়, এটি দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রাকৃতিক উৎস। আবহমান কাল থেকে দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং খাদ্যাভ্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে রুপালি ইলিশ। ইলিশের চাহিদা বরাবরই বেশি থাকে, বিশেষত বড় ইলিশের। বাজারে যখন এক কেজি বা তারচেয়ে বেশি ওজনের ইলিশ আসে, তখন তা বিশেষ ক্রেতাদের আকর্ষণ করে। কিন্তু, এ ধরনের বড় ইলিশের ক্রেতা কারা এ নিয়ে বাজারগুলোতে ঘুরে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্ট।

নীলফামারীর বড় বাজারের ইলিশ বিক্রেতা তপন রায়। ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইলিশ বিক্রি করছেন তিনি। এই মৌসুমের শুরু থেকেই তিনি ইলিশ বিক্রি করছেন। তার কাছে ৪০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি ওজন পর্যন্ত ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। বড় ইলিশ কারা কিনছেন? কোন সাইজের ইলিশ বেশি বিক্রি হচ্ছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশের দাম খুব বেশি। যার কারণে এবার ক্রেতাও খুব কম। আমরা ক্রেতা সেভাবে পাচ্ছি না। যারা দুই-তিন পিস মাছ নিত তারা এখন বাজারে আসে না।

বড় ইলিশ কারা কিনছেন? গড়ে প্রতিদিন কয়টি বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, ‘এখন ছোট মাছের বিক্রি বেশি। বড় মাছ কেউ হাত দিয়েও নাড়ে না। এক কেজির ওপরে মাছ ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা কিনতে হচ্ছে। ২০০০ বা ২১০০ চাইলে কাস্টমার নেয় না। এক কেজির ওপরে মাছ সকাল থেকে এক পিসও বেচতে পারি নাই। ছোট মাছ দুই-তিন কেজি বেচছি। মাঝারি মাছ বেচছি দুই পিস। ক্রেতারা আসে, দাম জিজ্ঞেস করেই চলে যায়। কেন চলে যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করলে বলে ভাই দাম বেশি। দাম কম হলে যারা মাছ কিনতে আসে তাদের সাধ্যের মধ্যে হলে একটার জায়গায় দুইটাও কিনে।’

বাজারের আরেক ইলিশ বিক্রেতা রঞ্জিত চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি তিন যুগের বেশি সময় ইলিশ বিক্রি করছি। আমাদের এলাকা মঙ্গা এলাকা। বর্তমান যে ইলিশের বাজার তাতে ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে। অনেকে বাজারে আসে, মাছ দেখে চলে যায়। যারা কিনছে তাদের ক্রয় ক্ষমতার নাগালে থাকায় কিনছে। বর্তমানে যে হারে মাছ সংগ্রহ করছি সেই হারে বেচা-বিক্রি নাই। সারাদিন যা বেচা-কেনা করছি তাতে আমাদের সংসার চলা খুবই কষ্টের হয়ে গেছে। মাছে যা খরচ হয় বরফ, লেবারসহ অন্যান্যতে তাতে আমাদের ঘাটতি হয়ে যায়। মাছের কেজি ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা হলে ক্রয়ক্ষমতার মাঝে থাকত, কাস্টমারও থাকত। মাছ বিক্রি বেশি হত, আমাদেরও পোষাইতে।’

বড় ইলিশ কারা কিনছেন? বড় মাছের বিক্রি কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, এক কেজির ওপর মাছ বিক্রি হচ্ছে খুবই সীমিত। জাটকা বিক্রি হচ্ছে বেশি। যাদের টাকা আছে তারাই এক কেজির ওপরের মাছ কিনছে। বড় মাছ ১২০০ টাকা মধ্যে থাকলে সবাই কিনতে পারতো। কিন্তু বড় মাছ মোকামেই ২০০০ টাকা কেজি।’

সরেজমিনে নীলফামারীর কয়েকটি মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারগুলোতে ১ কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১৮০০ টাকা করে। এর চেয়ে একটু বড় অর্থাৎ ১ কেজি ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০০ টাকায়। আর দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১৫০০ টাকায়। সেইসঙ্গে ৫০০ গ্রাম ওজনের কাছাকাছি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা কেজি দরে। বাজারে ক্রেতাদের বড় ইলিশের থেকে ছোট ইলিশ কিনতে আগ্রহী দেখা গেছে। বড় ইলিশের দাম বাড়তি হওয়ায় আক্ষেপ নিয়ে ছোট ইলিশ কিনছেন মানুষ। তাই খুচরা মাছ বিক্রেতারা বড় ইলিশের থেকে ছোট ইলিশ মাছ বেশি রাখছেন।

স্ত্রীর আবদার রাখতে নীলফামারী বড় বাজারে ইলিশ কিনতে এসেছেন কুন্দপুকুর এলাকার সলেমান আলী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পাঁচ বছর পর আজ ইলিশ কিনছি। আমার বাড়িওয়ালীর (স্ত্রী) শখ, ছোট হলেও একটা ইলিশ নিয়ে আসবেন। ছোট মাছটা একটু সাধ্যের মধ্যে। বড়টা কিনার সামর্থ্য নাই। ছোট মাছের দাম এরকম থাকলেও পরিবারের লোকজনকে খাওয়াইতে পারব। আমি বড় মাছের দাম জিজ্ঞেসও করিনি। ছোটটা ৬০০ টাকা কেজি চাইছে, সেটা তিন পিস কিনছি। আমরা তো নিম্ন শ্রেণির লোক, দাম কম থাকলে ভালো হয়। আমরা খাইতে পারতাম।’

এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮ জন। এক কেজি মাছ কিনলাম ২১৫০ টাকা দিয়ে। দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে তারপরও যদি পরিবারের প্রতিটি সদস্যসের পাতে এক পিস করে মাছের টুকরো পড়ে। দাম কম হলে সবার সুবিধা হত। সবাই ইলিশ কিনে খেতে পারত।

মমিনুল ইসলাম নামের আরেক ক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো ইলিশ কিনলাম। ৭০০ গ্রাম ইলিশ ১৫০০ টাকা কেজি দরে। এক কেজির ওপরে তো আরও বেশি দাম। সামর্থ্যের কারণে ছোট মাছ নিতে হয় আর কি। দাম কম থাকলে বেশি নেওয়া যেত। এক কেজি সাইজ বা তার থেকে বেশি ওজনের নেওয়া যেত। যেহেতু দাম বেশি এজন্য ছোটগুলো নিতে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা ইলিশ তো চাষের মাছ না, নদীর মাছ। সেক্ষেত্রে দামটা আমজনতার সাধ্যের মধ্যে থাকা উচিত। আশা করি উপদেষ্টামণ্ডলীরা বিষয়টা দেখবেন।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা, উলিপুর, নাগেশ্বরী, চিলমারী, রৌমারী, চর রাজিবপুর, গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ হয়। এই ১০ উপজেলার বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে তিস্তা অববাহিকার রংপুরের গংগাচড়া, কাউনিয়া, নীলফামারীর ডালিয়া এবং লালমনিরহাটের কিছু এলাকায় দেখা মেলে ইলিশের। তবে ধরলা, দুধকুমার ও তিস্তা নদীতে ইলিশের দেখা মিললেও সিংহভাগই ধরা পড়ে ব্রহ্মপুত্রে।

এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় সহকারী পরিচালক মনজুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২৩ সালে রংপুর অঞ্চলের চার নদীতে ইলিশ ধরা পড়ে ৩১৭ টন। এর আগে ২০২২ সালে ৩২৪ এবং ২০২১ সালে ধরা পড়েছিল ৩৩২ টন ইলিশ। এর মধ্যে গত বছর কুড়িগ্রামে ৩০৩ এবং গাইবান্ধায় ১৪ টন ইলিশ ধরা পড়ে। চলতি মৌসুমে এ পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা মৎস্য বিভাগের।

তিনি আরও বলেন, প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সাগর থেকে নদীতে আসে। সেই ধারাবাহিকতায় সাগর থেকে পদ্মা নদী হয়ে মেঘনা ও যমুনা পাড়ি দিয়ে ব্রহ্মপুত্র ও তার শাখাগুলোতে আশ্রয় নেয় ইলিশ। প্রজনন মৌসুম শেষে আবার সেই পথে সাগরে ফিরে যায়। তবে, ইলিশের উৎপাদন নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে আবহাওয়া পরিস্থিতি, বৃষ্টিপাত ও নদীর পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ।

ইলিশের প্রজনন মৌসুমে জেলেদের পুনর্বাসনে নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণে বিভিন্ন ভাগে সচেতনতামূলক কাজ করছে মৎস্য বিভাগ। গত কয়েক বছর ধরে রংপুর অঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোকে ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কারণে এ অঞ্চলে ইলিশের আনাগোনা বেড়েছে। একইসঙ্গে মোবাইল কোর্ট চালিয়ে নিয়মিত কারেন্ট জাল নিধনসহ জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এ অঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। শুধু তাই নয়, প্রজনন মৌসুমে জেলেদের পুনর্বাসনও করা হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য অধিদপ্তরসহ বাজার তদারকিতে সরকার সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানই জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছেন না বলে মনে করছেন ক্রেতারা। এ কারণে অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো ইলিশের বাজারও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। শুধু ইলিশ নিয়ে আলাদাভাবে বাজার মনিটরিংয়ে নেই তেমন কার্যকর পদক্ষেপ।

ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণে কী করা যেতে পারে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় সহকারী পরিচালক মনজুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ বা কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা মৎস্য বিভাগের কাজ না। আমরা জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকারের অভিযানে তাদের সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করি। মূলত সচেতনতা তৈরি করা, মাছের উৎপাদন বাড়ানো, জেলেদের পুনর্বাসনসহ অন্যান্য দিকগুলো নিয়ে মৎস্য বিভাগ কাজ করে আসছে। আলাদাভাবে ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করা বা মনিটরিং করার সুযোগ আমাদের হয়ে ওঠে না।

ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রজনন মৌসুমে ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত নদীতে জাল ফেলা নিষেধ। এ সময় যাতে নদীতে কেউ জাল না ফেলেন সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় জেলেদের যাতে জীবিকা নির্বাহে সমস্যা না হয়, সেজন্য সরকারিভাবে রংপুর অঞ্চলের ১৩ হাজার জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। আশা করছি, এতে করে জেলেরা মা ইলিশ ধরতে নদীতে যাবেন না। এ সময় জেলেদের সচেতনতার পাশাপাশি বাজার মনিটরিং ও নদীগুলোতে টহল জোরদার করা হবে। ফলে এবার ইলিশের উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বাড়বে।

মৎস্য অধিদপ্তরের মতো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেও ইলিশ নিয়ে নেই আলাদা কোনো তথ্য। সরকারি এ দুটি প্রতিষ্ঠানে নেই রংপুর অঞ্চলে ইলিশের চাহিদা ও কেনা-বেচা এবং বাজার মনিটরিংয়ের তেমন তথ্যসমৃদ্ধ পরিসংখ্যান। তবে এ অঞ্চলে চার নদ-নদীতে ইলিশের উৎপাদন ঘিরে আশার আলো দেখছেন তারা।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে ইলিশ নিয়ে আলাদাভাবে বাজার মনিটরিং করা, কাউকে জরিমানা করা কিংবা জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আমরা ভোক্তা সাধারণ এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কারসাজি রুখতে বেশি চেষ্টা করছি। তারপরও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যখন যেভাবে নির্দেশনা আসে সেটা করতে আমাদের কোনো কমতি থাকে না। যদি ভোক্তা সাধারণ থেকে অভিযোগ আসে সেটার ব্যাপারে আমাদের তৎপরতা সব সময়ই থাকে।

দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় তিন লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন, যার বাজার মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় এক শতাংশ।

ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু চলতি বছর বাংলাদেশই পড়েছে ইলিশ সংকটে। দেশের যেসব নদীতে একসময় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত সেসব নদীতেই এবার ইলিশের আকাল দেখা গেছে। জেলিফিশের বাড়বাড়ন্ত আর দফায় দফায় বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার সাগরেও ইলিশ ধরা পড়ছে কম। ফলে চলতি বছরের প্রথমার্ধে আগের বছরের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন কম হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ; যার প্রভাব পড়েছে বাজারেও।

বাংলাদেশে ইলিশের চারটি প্রজনন ক্ষেত্র এবং ছয়টি অভয়াশ্রম আছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। বিশেষ করে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর- এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। এর বাইরের উপকূলের অন্যান্য নদীগুলোতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে।

ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো মূলত মেঘনা নদী ও তার অববাহিকা এবং পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে চাঁদপুরে মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলায় মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা, তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা অন্যতম। এ ছাড়া পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা, বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকাও এর ভেতরে পড়ে।

মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গেল এক দশকে ইলিশ উৎপাদনের হার ছিল আকর্ষণীয়। বিশেষ করে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ টনের বেশি। হিসাব অনুযায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার টন ও সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন।

অবশ্য কাগজে-কলমে উৎপাদনের রেকর্ড গড়লেও বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। জেলে এবং এই খাতের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক বছর আগে ইলিশের উৎপাদন ভালো হলেও গত দুই-তিন মৌসুমে নদীতে উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে। সাগরেও ধরা পড়ছে তুলনামূলক কম।

অবসরপ্রাপ্ত মৎস্য জরিপ কর্মকর্তা জুবায়ের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইলিশ মূলত সাগরের মাছ। যেসব নদ-নদীর সঙ্গে সাগরের যোগসূত্র রয়েছে, সেই সব নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। রংপুর অঞ্চলে বর্ষাকালে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র খরস্রোতা হয়ে থাকে। ওই সময় তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রে ইলিশ পাওয়া যায়। সাগর থেকে ইলিশ আসে ডিম পাড়তে। রংপুর অঞ্চলে ইলিশের আগমন ঘটাতে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই। নদীগুলোকে খরস্রোতা করতে পারলেই দেশের অন্যান্য স্থানের মতো এখানকার নদীতে ইলিশ পাওয়া যাবে।

তিনি আরও বলেন, নদীর ভিন্ন চরিত্র ও বিরূপ আবহাওয়ার জন্য দিন দিন আমাদের ইলিশের উৎপাদন কমেছে। এর মধ্যে সাগর ও নদীতে সৃষ্ট ডুবোচর ও নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে সমুদ্র থেকে ইলিশ মিঠাপানিতে আসতে বাধা পেয়ে গতিপথ পরিবর্তন করা উৎপাদন কমার অন্যতম কারণ। ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ইলিশের উৎপাদন ভালো ছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমেছে। চাহিদার তুলনায় এখন জোগান কম থাকায় দিন দিন ইলিশের দাম বাড়ছে।

নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ। দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও একটি বড় ক্ষেত্র ইলিশ। এটিকে লালনপালন ও পরিচর্যা জরুরি। সঙ্গে বিভিন্ন গবেষণাধর্মী পরিকল্পনা নিয়ে সামনে আরও বেশি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দেশের নদ-নদীগুলো দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। নাব্যতা হারিয়ে বহু নদ-নদী মরতে বসেছে। এ কারণে ইলিশের অভায়শ্রমগুলো কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সে জায়গাগুলো থেকে উত্তরণ করা দরকার। ইলিশের বিচরণ পথ সুগম ও নিরাপদ করতে হবে। তা না হলে ইলিশের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। নদীর সুরক্ষার বিষয়টিও এখন জরুরি।

এমজেইউ