বুঝতে শেখার পরই বাবার সঙ্গে মাছ ধরার পেশায় যুক্ত হন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার মো. আলমগীর হোসেন। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে এ পেশায় থেকে তার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং ঋণের জালে জড়িয়ে তিন বেলা খেয়ে বেঁচে থাকাই এখন দায়!

এর মধ্যে একটু অসুস্থ হলে এলাকাবাসীর কাছে হাত পেতে চালাতে হয় চিকিৎসার খরচ। নিজ পরিবারের এমন দুর্দশার কথা বলছিলেন জেলে আলমগীর হোসেনের স্ত্রী রোকসানা বেগম।

শুধু আলমগীর একা নন, দুর্দশার এমন গল্প বরগুনার অধিকাংশ জেলে পরিবারের।

দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার টন মাছ বিক্রি হয় বিভিন্ন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। এর মধ্যে পাথরঘাটা বিএফডিসি ঘাটেই চলতি বছরের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ১৪০০ টন মাছ আনেন জেলেরা। এর মধ্যে ইলিশ মাছ ছিল ৯৫৭ টন। গভীর সমুদ্রে প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে তারা এসব মাছ আহরণ করেন। 

দেশে ব্যাপক চাহিদার পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ। দামও ভালো পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তবুও জেলেদের জীবনমানের উন্নতি নেই।

মাছ বিক্রির পর যে টাকা জেলেরা পান তার অর্ধেক দিতে হয় ট্রলারের মালিককে। এরপর দাদনের টাকাসহ সব ব্যয় মিটিয়ে বাকি টাকা জেলে ও মাঝিদের মাঝে সাড়ে ২০ ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে ট্রলারে থাকা মাঝি পান তিন ভাগ, সহকারী মাঝি পান ১.৫ ভাগ, বাবুর্চি পান ১.৫ ভাগ এবং ট্রলারে থাকা মিস্ত্রি পান ১.৫ ভাগ। বাকি সাধারণ জেলেরা পান সাড়ে ১২ ভাগ। এক্ষেত্রে যদি ছোট ট্রলার হয়, সেক্ষেত্রে জেলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০-১২ জন। যদি ১২ জন ধরা হয় তাহলে একেকজনের ভাগ্যে মাত্র এক ভাগের সমপরিমাণ অর্থ জোটে

জেলের লাভের গুড় খায় কারা?

আড়তদার থেকে শুরু করে ট্রলারের মালিক, বাজারের খুচরা মাছ বিক্রেতা— সবাই লাভবান হচ্ছেন। আর যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর থেকে মাছ আহরণ করে নিয়ে আসছেন সেই জেলেরাই প্রকৃত লাভের অঙ্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণ জেলেদের ভাগ্যে জোটে লাভের সামান্যতম অংশ। উল্টো সাগর থেকে শূন্য হাতে ফিরলে ঘাড়ে চাপে ঋণের খড়গ। এভাবেই দাদনের ঋণের ফাঁদে বন্দি হচ্ছেন অধিকাংশ জেলে।

জেলেরা কেন দাদনের ঋণে ফাঁদে বন্দি হচ্ছেন— এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পাথরঘাটা বিএফডিসি ঘাটের জেলেদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। রহমান নামের এক জেলে বলেন, ‘মাছ শিকারের জন্য প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন আমাদের সাগরে থাকতে হয়। এ সময় মহাজনের (আড়তদার) থেকে নেওয়া টাকার একটা অংশ পরিবারের কাছে দিয়ে যাই। যাতে তারা তাদের খরচ চালাতে পারে। বাকি টাকা দিয়ে ট্রলারের তেল, প্রয়োজনীয় খাবার ও উপকরণ নিয়ে আমরা সাগরে যাই। পরে সাগর থেকে ফিরে মাছ বিক্রি করে দাদন নেওয়ার টাকা পরিশোধ করি।’

‘অনেক সময় আবহাওয়া খারাপ হলে সাগর থেকে দ্রুত ঘাটে ফিরতে হয়। কোনো কোনো সময় সাগরে পর্যাপ্ত মাছ মেলে না। ফলে ট্রলারের খরচও ওঠে না। এমন হলে অনেক সময় দাদন পরিশোধ করতে পারি না। এক ঋণের মধ্যে আবারও নানা প্রয়োজনে মহাজনের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিতে হয়।’

খোকন নামের আরেক জেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনেক সময় সাগরে পর্যাপ্ত মাছ না পেলে দাদনের টাকাও পরিশোধ করতে পারি না। ফলে ঋণের ওপর ঋণের বোঝা চেপে ধরে মাথার ওপর। তখন আর কিছু করতে ভালো লাগে না। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। আমরা যেন কোনোভাবেই দাদনের এই মরণফাঁদ থেকে বের হতে পারি না।’

আসলেই কি দাদনের মরণফাঁদ আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরেছে অসহায় জেলেদের? জানতে চাওয়া হয় পাথরঘাটার এনাম এন্টারপ্রাইজের আড়তদার মো. আল-আমিনের কাছে। তিনি বলেন, একটা ট্রলার যখন সাগরে মাছ ধরতে যায় তখন তাদের (জেলেদের) থাকা-খাওয়াসহ আরও অনেক খরচের প্রয়োজন হয়। এ সময় তাদের কিছু টাকা দিয়ে সহযোগিতা করি। পরবর্তীতে তারা ঘাটে এসে মাছ বিক্রি করে আমাদের টাকা ফেরত দেয়। এক্ষেত্রে তারা আমাদের কাছেই মাছ বিক্রি করে। এতে আমাদেরও কিছু টাকা লাভ হয়। বিপদের সময় তাদেরও কিছুটা সহযোগিতা করা হয়। এর বাইরে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই।

জেলেরা চাইলে অন্য কারও কাছে মাছ বিক্রি করতে পারেন। এ বিষয়ে আমাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মাছ বিক্রি করে আমাদের টাকা ফেরত দিলেই হলো। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা আমাদের কাছেই মাছ বিক্রি করেন— যোগ করেন তিনি।
যেভাবে হয় ভাগ–বাঁটোয়ারা

জানা যায়, মাছ বিক্রির পর যে টাকা জেলেরা পান তার অর্ধেক দিতে হয় ট্রলারের মালিককে। এরপর দাদনের টাকাসহ সব ব্যয় মিটিয়ে বাকি টাকা জেলে ও মাঝিদের মাঝে সাড়ে ২০ ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে ট্রলারে থাকা মাঝি পান তিন ভাগ, সহকারী মাঝি পান ১.৫ ভাগ, বাবুর্চি পান ১.৫ ভাগ এবং ট্রলারে থাকা মিস্ত্রি পান ১.৫ ভাগ। বাকি সাধারণ জেলেরা পান সাড়ে ১২ ভাগ। এক্ষেত্রে যদি ছোট ট্রলার হয়, সেক্ষেত্রে জেলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০-১২ জন। যদি ১২ জন ধরা হয় তাহলে একেকজনের ভাগ্যে মাত্র এক ভাগের সমপরিমাণ অর্থ জোটে।

রেজাউল নামের এক জেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভাগ-বাঁটোয়ারার পর আমরা সাধারণ জেলেরা যে টাকা পাই, তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। সাগরে মাছ শিকার করতে যাওয়ার আগে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আমরা দাদন নিয়ে যাই। মাছ পেলে দাদনের টাকা পরিশোধ করতে পারি, না পেলে ঋণগ্রস্ত হয়ে যাই।’

জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন প্রসঙ্গে জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীনের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে আমরা বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। অনুদান হিসেবে বিভিন্ন সময় তাদের বকনা বাছুর দেওয়া হয়। অন্য আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যেক জেলেকে দুটি করে ছাগল ও ছাগলের ঘর দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সময় চাল সহায়তা দেওয়া হয়।
‘বরগুনা মৎস্য বিভাগের মধ্যস্থতায় বাওলাকার নামক এলাকায় একটি জেলে সমিতি আছে। সেখানে জেলেরা ৫০ টাকা করে জমা রাখেন। ওই সমিতি থেকে তারা বিনা সুদে ঋণ নিতে পারেন। এর মাধ্যমে তারা দাদন চক্র থেকে কিছুটা হলেও বের হতে পারেন’— যোগ করেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।

এমএসএ/