চাঁদপুর জেলা সুস্বাদু ইলিশ মাছের জন্য বিখ্যাত। তাই এ জেলাকে ‘ইলিশের বাড়ি’ বলা হয়। মেঘনাপাড়ের জনগোষ্ঠীর কাছে একটি বড় গর্বের জায়গা দখল করে আছে জাতীয় মাছটি। দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে ইলিশের জন্যই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে চাঁদপুর জেলা। এর স্মৃতিসরূপ জেলার বাসস্ট্যান্ড ও স্টেডিয়ামের সামনের সড়কের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে ‘ইলিশ চত্বর’ নামের ভাস্কর্য।

জেলা শহরের বড় স্টেশন এলাকায় দেশের বৃহত্তম ইলিশঘাট অবস্থিত। এ ঘাটে বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ আসে। এরপর সেই মাছ পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়। একসময় চাঁদপুর থেকে বিদেশেও সরাসরি ইলিশ রপ্তানি হতো। ইলিশ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন চাঁদপুরবাসী। কিন্তু বর্তমানে চাঁদপুরের ইলিশের বাজারে কোনো রপ্তানিকারক নেই বলে জানিয়েছেন জেলার ইলিশ ব্যবসায়ীরা।

এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবি, ঘাটে ইলিশের সরবরাহ কম। ভারতে রপ্তানি শুরু হওয়ায় পর দাম আরও বেড়েছে। আকাশছোঁয়া দামে অনেক ক্রেতার কাছেই ইলিশের স্বাদ নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতি লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, একসময় চাঁদপুরে পাঁচ-ছয়টি ইলিশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে ১৪-১৫ বছর আগে তৎকালীন সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আর তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেনি। ওই সময় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন মালেক খন্দকার, আনোয়ার গাজী, দেলোয়ার হোসেন খান, সেকান্দর আলী ও মিজানুর রহমান ভূঁইয়া কালু। চাঁদপুরে দিনের পর দিন ইলিশের সরবরাহ কমে যাওয়া, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স নবায়ন না করা এবং নতুন করে কেউ লাইসেন্স না নেওয়ায় জেলায় এখন আর কোনো ইলিশ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নেই।

তবে আনোয়ার হোসেন গাজী, দেলোয়ার হোসেন খানসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী দেশের অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে ইলিশ বিক্রি করছেন। এসব রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আবার ভারতে ইলিশ পাঠাচ্ছে। সরাসরি না হয়ে এখন হাত বদলে চাঁদপুরের ইলিশ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে চাঁদপুর থেকে যে সব থেকে ইলিশ ভারতে পাঠানো হতো, সেগুলোও জেলার বাইরের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠানো হতো বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

ভারতে ইলিশ রপ্তানি হবে— সরকারের এমন ঘোষণার পর জেলা থেকে প্রায় ২০০ মণ ইলিশ বিদেশে পাঠানো হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা-মেঘনার ইলিশসহ বঙ্গোপসাগর, দক্ষিণাঞ্চলের ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী, সন্দীপ ও বরগুনা থেকে চাঁদপুর জেলার মাছঘাটে ট্রাকে ও ট্রলারে ভরে ইলিশ মাছ আসে। এদিকে ঢাকা, শরীয়তপুর, কুমিল্লা, বগুড়া, যশোর, শেরপুর, জামালপুর, দিনাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ দেশে বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা পাইকারি ও খুচরা দরে এখান থেকে ইলিশ কেনেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঁদপুর থেকে ট্রেনে করে ইলিশ পরিবহন বন্ধ হয়ে যায় প্রায় এক দশক হলো। ফলে সড়ক পথে ইলিশ পরিবহনে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে আড়ত ব্যবসায়ীদের।

চাঁদপুর থেকে একসময় সিলেট ও ময়মনসিংহসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ট্রেনে ইলিশ পৌঁছানো হতো। ২০১৩ সাল থেকে ইঞ্জিন সংকট ও ওয়াগনের কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন বিকল্প হিসেবে ট্রাক ও ট্রলিতে ইলিশ পরিবহন করতে গিয়ে খরচ বেশি গুনছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ে চাঁদপুরের স্টেশন মাস্টার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় মাছের চাহিদা ছিল ৬৮ হাজার ৪৬৬ টন। উৎপাদন হয়েছিল এক লাখ ১৬ হাজার টন। ওই অর্থবছরে শুধু ইলিশ উৎপাদন বেড়েছিল ৩৪ হাজার ৩২৬ টন।

চাঁদপুর মাছঘাটে ইলিশের ক্রেতা আবু সফিয়ান বলেন, আমি কুমিল্লা থেকে এখানে এসেছি ইলিশ কিনতে। কিন্তু কুমিল্লার চেয়ে এখানে মাছের দাম অনেক বেশি। তাই খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে।

আরেক ক্রেতা আব্দুর রহিম বলেন, এখানে মাছের দাম বেশ চড়া। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ইলিশ কেনার সামর্থ্য নেই। তাই খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে।

চাঁদপুর মাছঘাটে আসা জেলে শুক্কুর আলী ও সিরাজ মিয়া জানান, পদ্মা-মেঘনার নদীতে আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায় না। যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যায় তা দিয়ে তেল ও নৌকার খরচ ওঠে না। গতবারের মতো এবারও নদীতে মাছ নেই।

শরীয়তপুর থেকে আসা পাইকার জামাল বলেন, আমরা সবসময় শরীয়তপুর থেকে চাঁদপুরে এসে পাইকারি দরে ইলিশ কিনে আমাদের স্থানীয় বাজারে বিক্রি করি। গত বছর এ ঘাটে অনেক মাছ আসতে দেখেছি, দাম ছিল কম। আমাদের স্থানীয় বাজারে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যেত। তবে, এবার এখানে মাছ খুবই কম, দামও চড়া। ঘাটে মাছ কম থাকায় এখন দুই-তিনদিন পরপর এখানে মাছ কিনতে আসি।

চাঁদপুর মাছঘাটের ইলিশ ব্যবসায়ী নবীর হোসন বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় ঘাটে ইলিশ কম আসছে। এ ছাড়া ভারতে ইলিশ রপ্তানির কারণে মাছের দাম বেড়েছে। প্রতি কেজিতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দাম বেড়েছে। যদি ঘাটে আগের মতো ইলিশ আমদানি হতো তাহলে ভারতে ইলিশ রপ্তানিতে দামের প্রভাব পড়তো না।

ইলিশের আড়তদার নূরে আলম বলেন, আমরা সরাসরি ইলিশ বিদেশে রপ্তানি করি না। এখানে কিছু বড় বড় কোম্পানি এসে ইলিশ কিনে নিয়ে যায়। তারা ভারতে রপ্তানি করে। এ কারণে মাছের দাম বেড়েছে। প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।

আরেক আড়তদার আবুল কালাম বলেন, একসময় ট্রেনে করে চাঁদপুর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এখন সেই সুবিধা বন্ধ। যদি সেটি আবার চালু করা যায় তাহলে ব্যবসায়ীদের অনেক সুবিধা হতো। গাড়িভাড়াতে খরচ কমলে ইলিশের দামও কমিয়ে আনা যেত।

ইলিশ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ভূইয়া কালু বলেন, একসময় আমাদের মধ্যে অনেকের বিদেশে ইলিশ রপ্তানির লাইসেন্স ছিল। ওয়ান ইলেভেনের সময় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। তখন থেকে আর কেউ লাইসেন্স নবায়ন করেনি। এখন হঠাৎ করে সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি শুরু করেছে। তাই এখন কিছু ব্যবসায়ী অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাইরে ইলিশ পাঠাচ্ছে। এ ছাড়া এখানে আর আগের মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশ আমদানি হয় না। তাই লাইসেন্স নবায়ন করে লাভ হবে না, কেউ নবায়নও করায় না। অন্যদিকে, লাইসেন্স করতে অনেক দিকে টাকা খরচ করতে হয়। আমারও ইলিশ রপ্তানির লাইসেন্স ছিল। মাছ কম সরবরাহ হাওয়ায় আমিও লাইসেন্স নবায়ন করিনি।

রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে ইলিশ বিক্রি করেন— জানিয়ে চাঁদপুর মাছঘাটের আনোয়ার হোসেন গাজী বলেন, এবার তুলনামূলক কম মাছ আসায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র ১০ টন ইলিশ বিক্রি করেছি। আমাদের এখানে মাছের আমদামি খুবই কম।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদী ও সাগরে ইলিশ নেই। বর্তমান আবহাওয়া মাছের উপযোগী না। কারণ, আগে চৈত্র-বৈশাখ মাসে ঝড়-তুফান হতো। এখন এর উল্টোটা হচ্ছে। বর্ষার শেষের দিকে ঝড়-তুফান হচ্ছে। ইলিশ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন হয়। প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে তারা চলাফেরা করে। ইলিশের মূল মৌসুম হলো আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস। এ সময়ে মাছ না থাকলে মাছের দাম তো বাড়বেই।

এখানে প্রতিদিনের চাহিদা ৪-৫ হাজার মণ। সেই তুলনায় বর্তমানে চাঁদপুর মাছঘাটে একেবারেই কম ইলিশ আসছে।

ট্রেনে ইলিশ পরিবহন সর্ম্পকে তিনি বলেন, চাঁদপুর থেকে ট্রেনে ইলিশ সরবরাহ আবার শুরু হলে আমাদের অনেক উপকার হবে। এ বিষয়ে আমি রেল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সর্ম্পকে শবে বরাত সরকার বলেন, একসময় চাঁদপুর থেকে সরাসরি বিদেশে ইলিশ রপ্তানি হতো। এখন এখানে কোনো রপ্তানিকারক নেই। আগে কয়েকজনের ইলিশ রপ্তানির লাইসেন্স ছিল। আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে তৎকালীন সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আর তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেনি। চাহিদা অনুযায়ী ঘাটে মাছ না আসায় কেউ আর লাইসেন্স নবায়ন করে না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতে আবার ইলিশ রপ্তানি শুরু করেছে। ফলে কিছু ব্যবসায়ী দেশের অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে ইলিশ বিক্রি করছেন। তাদের মাধ্যমে প্রায় ২০০ মণ ইলিশ চাঁদপুর থেকে রপ্তানি হয়েছে। আগের মতো ইলিশ সরবরাহ হলে হয়তো চাঁদপুরে আবারও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, চাঁদপুর থেকে বিদেশে ইলিশ বিক্রির জন্য সরাসরি রপ্তানিকারক কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবে, ব্যবসায়ীরা চাঁদপুর থেকে সারা দেশে অনলাইন ও অফলাইনে ইলিশ বিক্রি করেন।

ইলিশ গবেষক ও মৎস্য বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, ইলিশ দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। নদীর নির্ধারিত স্থানে দেখা না গেলেও অন্যান্য স্থানে ইলিশের দেখা মেলে। তবে, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পদ্মা ও মেঘনা নদীর পানিদূষণ, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনসহ নানা কারণে স্থানীয় নদীগুলোতে ইলিশের বিচরণ কমেছে। এ ছড়া বছরের নির্ধারিত সময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় এবার সেভাবে ইলিশের দেখা মিলছে না।

এফআরএস/