স্ত্রী, মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে বরিশাল জেলা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ইলিশ কিনতে এসেছেন সুলতান আহমেদ। দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করেও হতাশ হয়ে আলাপ করছিলেন চারজনে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘আজ আর না, যা দাম হ্যার (তার) চাইতে এক ভরি স্বর্ণ কেনোন (ক্রয়) সোজা, আরেকদিন কিনমু।’ এই বলে বের হয়ে যাচ্ছিলেন বাজার থেকে। তখন আলাপ হয় সুলতান আহমেদ ও তার পরিবারের সঙ্গে।

সুলতান আহমেদ বলেন, ‘দাম এ্যাত বেশি উঠছে যে কিনতে পারতেছি না। হুনিতো ফি বৎসর খালি ইলিশ বাড়ে, বাজারেও তো মন্দ আসে না, দাম তো কমে না। তাইলে এই ইলিশ বাড়ার মহত্বডা কী’— প্রশ্ন তোলেন তিনি। শুধু যে আজ তা কিন্তু নয়, এর আগেও একদিন এসে না কিনে ফিরে গেছেন সুলতান আহমেদ। যদিও মাঝখানে আরও দুদিন এসে কিনেছেন চড়া দামে। গত রোববার (৬ অক্টোবর) দুপুরে কথা হয় তার সঙ্গে।

সুলতান আহমেদের মতো একই প্রশ্ন খুচরা ব্যবসায়ী জুয়েলের। তিনি বলেন, ‘গত বছর পুঁজি খাটাইছিলাম ৮০ হাজার টাকা। এ বছর দেড় লাখ খাটাইয়াও লাভ করতে পারতেছি না। কী করমু কন, প্রতি মণ এত দামে কিনতে হয় যে ক্রেতা পাওন যায় না। হগোলডি (সকলে) কয় খালি ইলশা বাড়ছে, ইলশা বাড়ছে— ইলশার লগে দামও তো বাড়ছে।’

ব্যষ্টিক অর্থনীতি বা ক্ষুদ্র অর্থনীতির ধারণা অনুসারে, পণের উৎপাদন বা জোগান বাড়লে দাম কমবে। বাজারের অন্য পণ্যের বিষয়ে এমন সূত্র কার্যকর হলেও বিপরীত চিত্র কেবল ইলিশের ক্ষেত্রে। সরকারি হিসেবে উৎপাদন ও জোগান বাড়লেও বাজারে ধারাবাহিকভাবে দামও বাড়ছে।

সরকারি ব্রজমোহন কলেজের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বিগত দিনে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা যেভাবে শেখানো হতো সেভাবে। যেমন বলা হতো, গণতন্ত্র আছে অথচ মানুষ ভোট দিতে পারত না। তেমনি পণ্যের উৎপাদন ও জোগান বাড়লে দামও বাড়বে, এটা কোনো মার্কেটিং পলিসিতে নেই। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন বাজার ব্যবস্থা পাবেন না। শুধু বাংলাদেশেই অর্থনীতি ও মার্কেটিংয়ের সকল নীতি ভেঙে বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। মূলত অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। মূল্যস্ফীতির এটি একটি ট্রেন্ডিং হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে বাজার ব্যবস্থা মনিটরিংয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।’

মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় বলছে, বিগত ২৫ বছরে উৎপাদন বেড়েই চলেছে ইলিশের। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে নদী ও সাগরের আহরণ মিলিয়ে দেশের ইলিশ উৎপাদন ছিল দুই লাখ ১৯ হাজার ৫৩২ টন। ২০০০-০১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় দুই লাখ ২৯ হাজার ৭১৪ টন। ২০০১-০২ অর্থবছরে উৎপাদন হয় দুই লাখ ২০ হাজার ৫৯৩ টন। ২০০২-০৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয় এক লাখ ৯৯ হাজার ৩২ টন। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয় দুই লাখ ৫৫ হাজার ৮৩৮ টন। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে উৎপাদন হয় দুই লাখ ৭৫ হাজার ৮৬২ টন। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয় দুই লাখ ৭৭ হাজার ১২৩ টন। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে উৎপাদন হয় দুই লাখ ৭৯ হাজার ১৮৯ টন। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে উৎপাদন হয় দুই লাখ ৯০ হাজার টন। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয় দুই লাখ ৯৮ হাজার ৯২১ টন।

২০০৯-১০ অর্থবছরে উৎপাদন হয় তিন লাখ ১৩ হাজার ৭৫৩ টন। ২০১০-১১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় তিন লাখ ৩৯ হাজার ৮৪৫ টন। ২০১১-১২ অর্থবছরে উৎপাদন হয় তিন লাখ ৪৬ হাজার ৫১২ টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয় তিন লাখ ৫১ হাজার ২২৩ টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয় তিন লাখ ৮৫ হাজার ১৪০ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে উৎপাদন হয় তিন লাখ ৮৭ হাজার ২১১ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয় তিন লাখ ৯৪ হাজার ৯৫১ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদন হয় চার লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন হয় পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয় পাঁচ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৫ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয় পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৪২৮ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয় পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয় পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৩ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয় পাঁচ লাখ ৭১ হাজার ৩৪২ টন। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে গত বছরের রেকর্ড ভাঙবে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর।

ক্রমবর্ধমান উৎপাদন হলেও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজারে দামও বেড়েছে। মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে কেজিতে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় চারটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রগুলো হচ্ছে- বরিশাল জেলা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পোর্ট রোড, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর পাইকারী বাজার।

বড় বড় এসব বাজার থেকে খুচরা বাজারে এনে ইলিশ বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে এলসি (৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম) সাইজের ইলিশের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে এক হাজার টাকায়। ১২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হয়েছে ১১০০ টাকায়। দেড় কেজি ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হয়েছে ১৫০০ টাকায়। ওই বছর জাটকা বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা কেজি দরে।

২০১৯ সালে এলসি সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১১০০ টাকায়। ১২০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৩০০ টাকায়। দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। ওই বছর জাটকা বিক্রি হয়েছে ২৫০ টাকা কেজি দরে।

২০২০ সালে এলসি সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৫৫০ টাকায়। এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৭০০ টাকায়। ১২০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায়। ওই বছর জাটকা বিক্রি হয়েছে ২৫০ টাকা কেজি দরে।

২০২১ সালে এলসি সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায়। ১২০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায়। দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকায়। ওই বছর জাটকা বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে।

২০২২ সালে এলসি সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১১০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৩০০ টাকায়। ১২০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৩৫০ টাকায়। দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৫৫০ টাকায়। ওই বছর জাটকা বিক্রি হয়েছে ৪০০ টাকা কেজি দরে।

২০২৩ সালে এলসি সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৪০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৬০০ টাকায়। ১২০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৭০০ টাকায়। দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকায়। ওই বছর জাটকা বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকা কেজি দরে।

২০২৪ সালে এলসি সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬৫০ টাকায়। এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে ১৮৫০ টাকায়। ১২০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৯০০ থেকে ১৯৫০ টাকায়। দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২২০০ থেকে ২২৫০ টাকায়। এই বছর জাটকা বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে।

বরিশাল পোর্ট রোডের আড়তদার মাসুম সিকদার বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার জেলেদের কাছ থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ইলিশ কিনে বরিশালের আড়তে নিয়ে আসেন। মাছের সরবরাহের ওপর নির্ভর করে দাম ওঠা-নামা। এখন জাটকা আর নদীর ইলিশ বেশি আসছে। এজন্য দাম অনেক বেশি। তার ওপরে বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় দাম আরও বেশি বেড়েছে।

‘বর্তমান চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগও ইলিশ আসছে না। ইলিশ আসলে আবারও দাম কমে আসবে’— মনে করেন তিনি।

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচরের জেলে ইয়াসিন মোল্লা বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ইলিশের দাম ভালো পাচ্ছি। দুই-তিন বছর আগেও ইলিশ পানির দরে বিক্রি করতে হয়েছে। এবার দাম ভালো হলেও সাগরে যেতে পারছি না। নদীতে যা পাচ্ছি তাতে ইঞ্জিন খরচ উঠছে না।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. অপূর্ব রায় বলেন, ‘ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির সরকারি যে পরিসংখ্যান, সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই পরিসংখ্যান বাজারে গিয়ে সঠিকভাবে পরিমাপ করা হয় কি না, নাকি অনুমান নির্ভর— তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদি উৎপাদন বাড়ে তাহলে অর্থনীতির সূত্র অনুসারে দাম কমে আসার কথা। কিন্তু দাম কমছে না। এখানে আরেকটি ব্যাপার থাকতে পারে। জেলে থেকে ক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছাতে যে মার্কেটিং চ্যানেল, সেখানে কোথাও ত্রুটি রয়েছে। কেউ যদি আড়তে অতিরিক্ত পরিমাণে মজুত করে থাকেন তাহলে ক্রেতা পর্যায়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে। তখন দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।’

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ‘বাজার ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ না করলে, আর কারসাজি বন্ধ না হলে মূল্যের উল্লম্ফন কমানো যাবে না।’

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, ‘বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় উৎপাদন যেমন বেড়েছে, দামও তেমন বেড়েছে। কারণ, ইলিশের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। অতীতে যারা ইলিশ খেতেন না তারাও এখন ইলিশ কিনছেন। অর্থাৎ ক্রেতাও বেড়েছে বহু গুণে। ক্রেতা বেড়ে যাওয়ায় দাম ও চাহিদা বেড়েছে। শুধু যে দেশের মানুষ খাচ্ছেন তা কিন্তু নয়। আমাদের এক কোটিরও বেশি প্রবাসী দেশ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে ইলিশ কিনে নিচ্ছেন। বিদেশের শোরুমে আমাদের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে আমাদের ইলিশের আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি হয়েছে। এই চাহিদার ওপর ভিত্তি করে দামও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।’

আরএআর/