প্রতি বছর ইলিশের মৌসুম শুরু হলেই দক্ষিণ অঞ্চলের কয়েক হাজার সমুদ্রগামী জেলের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সমুদ্র থেকে ট্রলারভর্তি করে তারা নিয়ে আসেন রুপালি ইলিশ। কয়েক হাত বদলের পর সাধারণের হাতে পৌঁছায় বাঙালির সাধের মাছ।

প্রথম পর্যায়ে মাছ কেনেন দেশের বিভিন্ন অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদাররা। পাইকাররা ঘাটের আড়তদারদের কাছ থেকে যে দামে ইলিশ কেনেন, তা কয়েক হাত ঘুরে বাজারে পৌঁছাতেই কেজিপ্রতি দাম বেড়ে যায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এ ছাড়া মণপ্রতি দৈনিক কেমন দামে ইলিশ বেচাবিক্রি হবে তা ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মোকাম থেকে নির্ধারণ করা হয়।

সরেজমিনে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বিএফডিসি ঘাট ঘুরে দেখা যায়, রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা সাগর থেকে মাছ শিকার করে ঘাটে ফিরছে ছোট-বড় অসংখ্য ট্রলার। তবে, সকালের দিকেই বেশি ট্রলার ঘাটে আসে। সাগরের আবহাওয়া ঠিক থাকলে প্রত্যেকটি ফিরে আসা ট্রলার বোঝাই থাকে রুপালি ইলিশে। ঘাটে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে নির্ধারিত পারিশ্রমিকে ট্রলার থেকে মাছ তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ঘাটশ্রমিকরা। পরে এসব মাছ ডাকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দামে আড়তদারদের থেকে কিনে নেন ঘাটে থাকা পাইকাররা।

পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বিএফডিসির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ঘাটে ইলিশের অবতরণ হয়েছে ৯৫৭ টন। প্রথমে মাছগুলো সাইজ-ওজন দেখে বিভিন্ন গ্রেডে ভাগ করা হয়। পরে গ্রেড অনুযায়ী আড়তদারের মাধ্যমে পাইকারদের কাছে বিভিন্ন দামে বিক্রি করা হয়। সাধারণত এক কেজি ওজনের বেশি সাইজের মাছগুলোর চাহিদা অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করা হয়। মণপ্রতি যা ৬৫ থেকে ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাঁড়ায়। এর নিচে ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের যে ইলিশ পাওয়া যায় তার দাম নির্ধারণ করা হয় মণপ্রতি ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়। চার থেকে পাঁচটি ইলিশ মিলিয়ে এক কেজি হলে অর্থাৎ জাটকার দাম নির্ধারণ করা হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়।

পরে মাছগুলো ঘাটের পাইকারদের মাধ্যমে প্রসেসিং করে পাঠানো হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে। ওইসব মোকাম থেকে তা চলে যায় খুচরা বাজারে। খুচরা বাজার থেকে সাধের ইলিশ পৌঁছায় সাধারণ ক্রেতাদের হাতে। তবে, ঘাট থেকে বাজার পর্যন্ত ইলিশ পৌঁছাতে বদল হয় তিন থেকে চার হাত। ফলে যে দামে পাইকাররা ঘাট থেকে ইলিশ কেনেন, খুচরা বাজরে পৌঁছে তা কেজিপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়ে যায়।

ঘাটে ইলিশ অবতরণের পর কীভাবে ডাকের মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করা হয়— জানতে চাইলে পাথরঘাটার মেসার্স তরিকুল ইসলাম সবুজ ফিসের ম্যানেজার মো. আল আমীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন সকালে পাইকাররা মোকামে ফোন দিয়ে মাছের চাহিদা জেনে সে অনুযায়ী একটা দাম নির্ধারণ করেন। পরে ডাকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে মাছ বিক্রি করা হয়। 

‘চলতি বছর বড় মাছ কম ধরা পড়ায় দাম একটু বেশি’ বলেও জানান তিনি।

মো. জাকির হোসেন নামের মৎস্য ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন ইলিশ মাছের মৌসুম চলছে। বাংলাদেশে প্রায় আট থকে ১০টি মৎস্য অবতরণের ঘাট রয়েছে। যখন বিভিন্ন ঘাটে মাছ বেশি ওঠে তখন দাম কমে। যখন মাছ কম ওঠে তখন চাহিদা অনুযায়ী মাছের দাম বাড়ে। দেশের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে ঢাকার মোকামের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে যোগাযোগ হয়। তাদের চাহিদা অনুযায়ী মাছের দাম নির্ধারণ করা হয়।

প্রতিদিন মাছ কেনার পর কীভাবে তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেওয়া হয়— জানতে চাইলে পাইকার মো. জাহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘাট থেকে মাছ কিনে আমরা প্রথমে চটের ওপর বিছাই। পরে ২০০ টাকা খরচ করে ৫০ কেজির একেকটি কর্কশিটে প্যাকেজিং করা হয়। কর্কশিটপ্রতি লেবারদের পারিশ্রমিক দিতে হয় ১০০ টাকা। বরফ কিনতে হয় ২০০ টাকার। এ ছাড়া লেবারদের সমিতিকে দিতে হয় ৫০ থেকে ৭০ টাকা। পরে ঘাটের কাজ শেষ করে ঢাকা পর্যন্ত একেকটি কর্কশিটের জন্য ট্রাক ভাড়া দিতে হয় ৫০০ টাকা। এ ছাড়া যে আড়তদারের কাছ থেকে মাছ কেনা হয় সেখানে কমিশন দিতে হয় শতকরা দুই থেকে তিন টাকা।  

ঘাটের বিভিন্ন আড়তদারদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন তিন থেকে চার হাত বদল হয়ে ইলিশ পৌঁছায় দেশের বিভিন্ন খুচরা বাজারে। এতে পাইকাররা যদি কেজিপ্রতি ১৫০০ টাকা দরে ইলিশ কেনেন, তা মোকাম ঘুরে বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়ে মূল্য দাঁড়ায় ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা। পরে একজন সাধারণ ক্রেতাকে বাজার থেকে ওই মাছ কিনতে হয় কেজিপ্রতি দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকায়। অপরদিকে, চাহিদার তুলনায় মাছের সরবরাহ কম হলে এ দাম আরও বেড়ে যায়।

পাথারঘাটার বিএফডিসি ঘাট ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জি এম মাসুদ শিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাথরঘাটার বিএফডিসি ঘাট দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। ইলিশ মৌসুম এখন প্রায় শেষের দিকে। জেলেরা আবহাওয়ার বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে কম-বেশি মাছ শিকার করে এখানে অবতরণ করেন। এটি উন্মুক্ত মার্কেট হওয়ায় এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা আসেন। ফলে যে পাইকার মাছের দাম বেশি বলেন, আড়তদার তার কাছেই মাছ বিক্রি করেন।

‘এখানে মাছের সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে। সরবরাহ কম হলে চাহিদা অনুযায়ী দাম বাড়ে। এ ছাড়া পাইকাররা এখান থেকে মাছ কেনার পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠান। ফলে দুই-তিন হাত বদল হওয়ায় মাছের দাম বেড়ে যায়।’

আরকে/