আলোচিত কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার তদন্ত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তার বাবা রফিউর রাব্বি। এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন-এমন খবরে তিনি এই সংশয় প্রকাশ করেন।

শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান ও ভাতিজা আজমেরী ওসমানকে গ্রেপ্তার এবং তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন রাব্বি।

মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার ১২৯ মাস উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচিতে তিনি এ দাবি জানান।

প্রতিমাসের ৮ তারিখের মতো শহরের চাষাঢ়ায় শহীদ মিনারে আলোক প্রজ্বালন কর্মসূচির আয়োজন করে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট।

রফিউর রাব্বি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমান জড়িত। শুরু থেকেই আমরা এই কথা বলেছি। ত্বকী হত্যার কয়েকদিন পর নাসিম ওসমান ও তার ছেলে আজমেরী ওসমানের যে সাড়ে ৪ মিনিটের টেলি-কথোপকথন আমরা শুনেছি, সেখানে আজমেরী বলছে, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অয়ন ওসমান। এইটা অনেকে শুনেছে, তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাবের কাছেও তা রয়েছে। সুতরাং এই হত্যার সঙ্গে যারা যারা জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

তিনি বলেন, ত্বকী হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের কথা জানায় র‌্যাব। ২০১৪ সালে র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আজমেরী ওসমান ও তার বাহিনী জড়িত। আজমেরীর নেতৃত্বে ১১ জন ত্বকীকে হত্যা করেছে। তখন আমরা টেলি-কথোপকথনের বিষয়টি নিয়ে র‌্যাবের কাছে জানতে চাইলাম। তখন র‌্যাবের এডিজি ছিলেন কর্নেল মুজিব। তিনি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন। তার হস্তক্ষেপে ও ইচ্ছাতে শামীম ওসমান ও তার ছেলের নাম সেইখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। তাই আমরা বলেছি, তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত না করা পর্যন্ত চার্জশিট পূর্ণতা পাবে না। ২০১৩ সালে যা উদঘাটিত হয়েছে তদন্তকারী সংস্থা যদি তার মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে চায় তাহলে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। 

রফিউর রাব্বি বলেন, আমাদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। এই কারণে যে, এই খুনি, ঘাতক পরিবার সারা দুনিয়ায় চিহ্নিত হওয়ার পরও তারা একজনও গ্রেপ্তার হলো না কীভাবে? শুনছি, তাদের পরিবারের সকলে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। যদি তারা পালিয়ে যেতে পারে, তাহলে তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ কারা দিল, কারা সহযোগিতা করল? তাদের সহযোগীরা এখন পর্যন্ত পরিবর্তিত সরকারের বিভিন্ন সংস্থায়, বিভিন্ন জায়গায় বিরাজমান। তাই এই সংশয় থেকে বলছি যে, ত্বকী হত্যার সমস্ত তদন্তকাজ সম্পন্ন হওয়ার পরেই নিশ্চিত হতে পারবো যে, এটি কতটা সুষ্ঠুভাবে এবং প্রভাবহীনভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

ত্বকীকে অপহরণের পর সায়াম প্লাজায় নিয়ে যাওয়া হলো, ওইটা শাহ নিজামের (শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী) অফিস। ৬টার সময় অপহরণ হলো আর আজমেরীর টর্চার সেলে নেওয়া হলো ৯টার পর। ত্বকীর অপহরণ ও আজমেরীর নির্যাতন কেন্দ্রে নেওয়ার মধ্যবর্তী সাড়ে তিন ঘন্টা ত্বকী কোথায় ছিল এবং সেখানে কারা কারা ছিল তাদের চিহ্নিত করার দাবি জানান ত্বকীর বাবা। 

শামীম ওসমানের লোকজন নারায়ণগঞ্জে থাকলেও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না অভিযোগ করে রাব্বি বলেন, শামীম ওসমানের লোকজন বসে আছে নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিক, আইনজীবীদের মধ্যে শামীম ওসমানের লোকজন রয়েছে। আমরা সবাই তা জানি। তারা এখনো পর্যন্ত তো ধরা পড়েনি। শামীম ওসমানের খুনিরা, চাঁদাবাজরা, মাদক ব্যবসায়ীরা, দখলবাজরা, কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। এতগুলো খুন করার পরও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। প্রশাসন তাদেরকে পাহারা দিয়ে রাখছে না, তা কীভাবে বুঝবো?

ত্বকী হত্যার বিচারের পাশাপাশি আলোচিত হত্যাকাণ্ড সাগর-রুনি ও তনু হত্যারও বিচার দাবি করেন রফিউর রাব্বি।

তিনি একইসাথে ‘শেখ হাসিনা রেজিমের হাতে’ গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করেন।

নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি জিয়াউল ইসলাম কাজলের সভাপতিত্ব ও সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েলের সঞ্চালনায় কর্মসূচিতে আরও বক্তব্য দেন খেলাঘর আসরের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি রথীন চক্রবর্তী, সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্য সচিব কবি সাংবাদিক হালিম আজাদ, দৈনিক খবরের পাতার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম, সিপিবির জেলা সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায়, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক দীপু, ন্যাপের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা কমিটির সমন্বয়কারী তরিকুল সুজন, বাসদের জেলা কমিটির সদস্য সচিব আবু নাইম খান বিপ্লব, ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদক হিমাংশু সাহা, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সভাপতি মাহামুদ হোসেন, সামাজিক সংগঠন সমমনার সাবেক সভাপতি দুলাল সাহা প্রমুখ।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেল ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শায়েস্তা খান রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয় ত্বকী। পরদিন তার ‘এ’ লেভেল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়, যেখানে দেখা যায় ত্বকী পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়েছিল। ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খাল থেকে ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দীর্ঘ সময় আটকে থাকলেও গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গতি পেয়েছে। গত এক মাসে ত্বকী হত্যা মামলায় ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তাদের মধ্যে একজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।

আরএআর