‘আমগো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নাই’
সিমেন্টের বস্তা দিয়ে বানানো ত্রিপল দিয়ে চারপাশ ঢাকা একটি ঝুপড়ি ঘর। চালে কয়েকটি টিন দেখা গেলেও তা জরাজীর্ণ। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে চালটিও ঢেকে রাখা হয়েছে ত্রিপল দিয়ে। ঘরে লাগানো বাঁশসহ কাঠের খুঁটিগুলো বন্যার পানিতে পচে গেছে। ভিটে থেকে মাটিও ধুয়ে গেছে বন্যায়। ঘরে একটি চকি থাকলেও তা পচে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। রাত্রিযাপনের জন্য এখন একমাত্র ভরসা মাটিতে বিছানো একটি পাটি। ঘরে কোনো দরজা নেই। ঘরে ঢুকতেই ভাঙা চালা দিয়ে দেখা মেলে বিস্তীর্ণ আকাশ। আসবাবপত্র বলতে কিছু হাঁড়িপাতিল ছাড়া আর কিছুই নেই।
এমন জরাজীর্ণ পরিস্থিতিতেই ভর করে বেঁচে আছেন লক্ষ্মীপুরের বৃদ্ধ মোস্তফা মিয়া ও নুরজাহান বেগম দম্পতি। তারা জেলা সদরের দিঘলী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব দিঘলী গ্রামের ওয়াপদা বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা। বন্যায় তাদের ঝুপড়ি ঘরটিতেই প্রায় বুক পরিমাণ পানি ছিল। এতে প্রায় দেড় মাস ঘরের পাশের বেড়িবাঁধের রাস্তার ওপর বসবাস করেছেন তারা। দেখলে মনে হবে তাদের জরীজীর্ণ ঘরটি যেন শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, মোস্তফা-নুরজাহান দম্পতির কোথাও কোনো জমি নেই। তারা বেড়িবাঁধের নিচে খালের পাশে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। মোস্তফা পেশায় রিকশাচালক। বয়স হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেন। রিকশা নিয়ে সব সময় বের হতে পারেন না। তাদের তিন ছেলেই বিবাহিত। ছেলেদের সংসারও অভাব-অনটনে ঢেকে আছে। স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণও ঠিকমতো দিতে পারছেন না তারা। এতে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে না থেকে বৃদ্ধ মোস্তফা-নুরজাহান নিজেদের খাবার নিজেরাই কোনো মতে ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন। তবে জরাজীর্ণ ঘরটি মেরামত করার মতো কোনো অবস্থা তাদের নেই। এতে সিমেন্টের বস্তার ত্রিপল দিয়ে ঘরে বেড়া দিয়েছেন। আর চালেও টিনের পরিবর্তে ত্রিপল ব্যবহার করছেন।
জানতে চাইলে বৃদ্ধা নুরজাহান বেগম বলেন, ১০ দুয়ারের (দরজা) তুন (থেকে), খুঁজিখাঁজি আনি (এনে) খাই। জীবনভর দুই রতেরে (শরীর) খোয়ায় (ক্ষয় করে) মাইনষের বাঁধুনি বাঁধি (ধানের কাজ) হেন (ভাতের মাড়) আনি যাদুগোরে (সন্তান) লই (নিয়েছি) খাইছি। অন যাদুগো খা-উইননা বেশি, আমগোরে কতুন (কীভাবে) খাওয়াইবো। ঘর নাই-দুয়ার নাই, ভাত নাই-হানি (পানি) নাই, কি খাইয়াম। ঘর দুয়ারে থাইকতাম হারি (পারি) না। একখান চই (চকি) নাই, চাডাই (চাটাই) নাই। ঘরে হানি ঢুকে। হোলা (ছেলে) ৩ জন আছে, হেতারা ভিন্ন খায়। হেতাগো সংসারই ভারি অই গেছে। আমারে খাওয়াইবো কতুন। এক হোলার মাঞ্জার (কোমড়ের) আড্ডি (হাড়) ক্ষয় অই গেছে। তার হোলামাইয়া চাইরগা, হেগুনরে খাওয়াইবো নাকি আমগোরে খাওয়াইবো। আমগো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নাই।
মোস্তফা মিয়া বলেন, ঘরে হালা (খুঁটি) নাই, বেড়া নাই। দেখেন কাগজ দিয়ে বেড়া দিছি। বাঁশের হাইল-ভুতুর (আড়া) হেগিনও সব ভাঙি গেছে।
আরও পড়ুন
মোস্তফা মিয়ার পুত্রবধূ লাকি বেগম বলেন, আমাদের কোনো জায়গা জমি নেই। সরকারি জমিতেই বসবাস করি। বন্যায় ঘরে কোমড় পরিমাণ পানি ছিল। পানিতে ঘরের খুঁটিগুলোতে পচন ধরেছে। সন্তানদের নিয়ে ঝুঁকিতে আছি। ঘরের আড়া ভেঙে পড়ে গেছে। এখনো ঠিক করতে পারিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মোস্তফা ও নুরজাহান খুব কষ্ট করে দিনাতিপাত করে। তাদের ছেলেরা অভাব অনটনে রয়েছে। চাইলেও বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। বৃষ্টিতে এ দম্পতির ঘরে পানি ঢোকে। এছাড়া বন্যায় প্রায় বুক সমান পানি ছিল। এতে খুঁটিগুলো পচে গিয়ে ঝুপড়িটি ঝুঁকে পড়েছে। বলতে গেলে এখন প্রায় শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তাদের ঘরটি।
প্রসঙ্গত, আগস্ট মাসের প্রথম দিকে টানা বৃষ্টিতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন ইউনিয়নে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে বিভিন্ন স্থানে ২-৩ ফুট পানি জমে কৃত্রিম বন্যা দেখা দেয়। সেই পানি কমার আগেই ২২ আগস্ট থেকে নোয়াখালীর বন্যার পানি ঢুকে পড়ে লক্ষ্মীপুরে। এতে পানি আরও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। পূর্ব-পশ্চিম দিঘলী গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনো বন্যার পানিতে ডুবে আছে গ্রামীণ রাস্তা ও বাড়ির উঠান।
আরএআর