লক্ষ্মীপুরে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা ও বন্যার পানিতে ৪০ হাজার ৮০১টি বসতঘরের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রায় ৩৮৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পানিতে বাঁশ-কাঠের খুঁটিগুলো পচে গিয়ে প্রত্যেকটি ঘর হেলে পড়েছে। ঝুঁকি নিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলোতে মানুষজনকে বসবাস করতে হচ্ছে। বন্যা শুরুর দেড় মাস পার হলেও জেলার কয়েকটি এলাকায় এখনো বাড়ির উঠান-গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে আছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া পচা-দুর্গন্ধযুক্ত পানি মাড়িয়ে চলাফেরা করতে কষ্ট হচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের।

শুক্রবার (৪ অক্টোবর) সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব দিঘলী ও পশ্চিম দিঘলী গ্রামে ওয়াপদা বেড়ি-সংলগ্ন এলাকায় গ্রামীণ রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে থাকতে দেখা যায়। এর আগে বুধবার (২ অক্টোবর) রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে ৫-৬ ইঞ্চি পানি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ওই এলাকার বাসিন্দা সুরাইয়া বেগম, জাহেদা আক্তার, তাসলিমা বেগম, হাজেরা বেগম, মমিন উল্যা ও রানু বেগমসহ কয়েজনের ঘর বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখা গেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামত নিয়ে ভুক্তভোগীরা একই অভিযোগ করছেন। তাদের দাবি, কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। এখনো তাদের বাড়িঘর ও রাস্তা থেকে পানি নামেনি। পচা পানি ভেঙে তাদের চলাফেরা করতে হচ্ছে। বন্যার পানিতে ঘরের বাঁশ ও কাঁঠের খুঁটিগুলো পচে গেছে। কয়েকটি সিমেন্টের খুঁটির কারণে এখনো ঘর দাঁড়িয়ে আছে। তা না হলে আরও আগেই ভেঙে পড়তো। ঘরের বেড়া পচে পড়ে গেছে। ঘর মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত টাকা-পয়সাও তাদের কাছে নেই। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাতেও তারা চোখে সবকিছু অন্ধকার দেখছেন। 

ঘরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে কথা হয় স্বামী পরিত্যক্তা পশ্চিম দিঘলী গ্রামের বাসিন্দা সুরাইয়া বেগমের সঙ্গে। বন্যার পানি এখনো তার বাড়ি থেকে নামেনি। বাড়িতে যেতে এখনো হাঁটুসমান পানি ভাঙতে হয়। পচা পানিতে চলাফেরা করায় তার শরীরের অ্যালার্জি হয়ে ক্ষত হয়ে পড়েছে।

সুরাইয়া বেগম বলেন, বন্যার পানিতে ঘরের পশ্চিমের ভিটের মাটি দুই-তিন  হাত সরে গেছে। এতে খুঁটির নিচে মাটি না থাকায় ঘরের আড়া সবগুলো ভেঙে পড়ছে। বন্যায় পনির স্রোত এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। এই বাড়িটি ছাড়া আমাদের আর কিছুই নাই। বাড়িতে পা দেওয়ার মতো এক টুকরো জায়গা নেই। মানুষের জমির ওপর দিয়ে যাওয়া-আসা করি। ২-৩ লাখ টাকা খরচ হবে ঘরটি মেরামত করতে। কিন্তু এক টাকাও নেই আমার কাছে। আমি অনেক কষ্টে আছি। মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাই। আল্লাহ যদি কোনোভাবে ঘর মেরামতের টাকা ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে উপকার হবে। এ ছাড়া সামনে অন্ধকার দেখছি।

জাহেদা আক্তার নামে এক বিধবা নারীর ঘরও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার ঘরটিও বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। প্রায় পাঁচ মাস আগে ধারদেনা করে বড় ছেলেকে চাকরির জন্য দুবাই পাঠিয়েছেন। এখনো ধারদেনায় শোধ হয়নি। এরমধ্যে বন্যায় তার ঘরটির ভিটে থেকে মাটি সরে গেছে। ঘরের খুঁটিগুলোর নিচের অংশ পচে গেছে। ঘরে থাকা চকির খুঁটিগুলোতেও পচন ধরেছে।

জাহেদা আক্তার বলেন, নিজের খাবারও নাই, গরুর খাবারও নাই। এখন বাড়িতে গিয়ে যে একটা বালিশ মাথায় দেবো, সেই জোগানও নেই। পানিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় ৩ বছর আগে আমার স্বামী মারা গেছেন। তার চিকিৎসার জন্য বহু টাকা ধার দেনা করেছি। ওই টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। এখন বন্যায় ঘরটিও ভেঙে পড়ছে। কিন্তু ঠিক করার মতো কোনো টাকা নেই। ভাঙা ঘরেই ডর-ভয় নিয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে। বন্যায় বেড়িবাঁধের ওপর ছিলাম। পরে লোকজন এসে আমাদেরকে উঠিয়ে দিয়েছে। বাড়ির চারপাশে এখনো পানি।

ক্যামেরার সামনে কথা না বললেও তাছলিমা বেগম নামে এক নারী বন্যায় ক্ষতির কথা প্রতিবেদকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বন্যার প্রথম এক মাস ঘরেই ছিলাম। পরে খাটের ওপর পানি উঠলে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাই। সেখানেও পানি উঠলে পরে বেড়ি রাস্তার ওপর ত্রিফল লাগিয়ে ঝুঁপড়ি ঘরে অন্যদের মতো আশ্রয় নিয়েছি। ঘর থেকে পানি নেমেছে। কিন্তু এখনো বাড়ির উঠানে পানি। বাড়িতে আসার রাস্তাতেও প্রায় দেড় ফুট পানি আছে। ঘরে ভিটে থেকে সব মাটি ধুঁয়ে গেছে। সবগুলো খুঁটির গোড়ায় পচন ধরেছে। মেরামত না করলে বেশিদিন এ ঘরে থাকা যাবে না। ঘরের আসবাবপত্রও নষ্ট হয়ে গেছে।

দিঘলী ইউনিয়নের ওয়াপদা বেড়িবাঁধের রাস্তায় প্রবেশ করে কিছুদূর যেতেই দেখা মেলে একটি ঘর রশি দিয়ে গাছের সঙ্গে টানা বাঁধ দেওয়া। ঘরের একপাশে বেড়িবাঁধ অন্যপাশে খাল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমিতেই ঘরটি। দীর্ঘ বছর ধরে হাজেরা বেগম নামে এক বিধবা নারী তার সন্তানদের নিয়ে এখানে বসবাস করছেন। এবারের বন্যায় ঘরের ভিটের মাটি সরে গিয়ে খালের দিকে হেলে পড়ছিল। তখন ঘরটি রক্ষা করতে রশি দিয়ে গাছের সঙ্গে টানা বাঁধ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাজেরা বেগম।

কৃষক মমিন উল্যা পশ্চিম দিঘলী গ্রামের বাসিন্দা ও পেশায় কৃষক। আগস্টের প্রথম দিকেই টানা বৃষ্টিতে তাদের চলাচলের রাস্তা ও বাড়িতে পানি ওঠে। পরে বন্যার পানিতে ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়ে। ঘরের ভেতরেই প্রায় কোমরসমান পানি ছিল। এ সময় প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের মতো তিনিও ওয়াপদা বেড়িবাঁধের রাস্তায় ঝুঁপড়ি ঘর বানিয়ে আশ্রয় নেন। এদিকে বন্যায় তার ঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

মমিন উল্যা বলেন, ঘর-দুয়ার বন্যায় ভেঙে গেছে। ঘরের মাটি ধুয়ে গেছে। এ ঘর মেরামত করতে প্রায় ২ লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে। বন্যার কারণে এবার চাষাবাদও করতে পারিনি। এতে আমার উপার্জনই বন্ধ হয়ে গেছে। ঘর মেরামতের কোনো টাকাও নেই।

পূর্ব দিঘলী গ্রামে গিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ওমান প্রবাসী দেলোয়ার হোসেনের ঘর মেরামত করতে দেখা যায়। জানতে চাইলে তার স্ত্রী রানু বেগম বলেন, টানা বৃষ্টিতে প্রথমেই আমাদের ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। পরে বন্যার পানিতে তা দ্বিগুণ হয়ে পড়েছিল। এতে আমরা বেড়ির রাস্তার ওপর আশ্রয় নিই। প্রায় দেড় মাস আমরা বেড়ির রাস্তার ওপর ছিলাম। আমাদের ঘরটিও ওয়াপদা জমিতে। আমাদের কোনো জমি নেই। বন্যায় ঘরটির খুঁটিগুলো পচে হেলে পড়েছে। ঘরের পাশে থাকা একটি কড়ই গাছ উপড়ে পড়ে ঘর আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন ঘরটি মেরামত করছি। কিন্তু ঘরে কোনো আসবাবপত্রই নেই। সব নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু চারদিকে এখনো পানি থাকায় ভিটেতে দেওয়ার জন্য মাটি খুঁজে পাচ্ছি না। এ বন্যায় ঘর নষ্ট হয়ে আমাদের প্রায় দেড় লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া বলেন, বন্যায় জেলার ৪০ হাজার ৮০১টি কাঁচা ও পাকা ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৩৮৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারিভাবে সহায়তা আসতে পারে। বরাদ্দ সাপেক্ষে অধিক ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হবে।

হাসান মাহমুদ শাকিল/এএমকে