গামছায় লুকানো মুখ। সঙ্গে ধারালো রামদা ও হাঁসুয়া। মধ্যরাতে শহরের আবাসিক এলাকাগুলোতে তাদের অবস্থান। সূর্যোদয়ের আগে কেউ বাড়ির দরজা খুললেই ফিল্মি স্টাইলে ভেতরে প্রবেশ। এরপরই দেশীয় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুট। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টার দিকে ফিল্মি স্টাইলে এমনই এক দুর্ধর্ষ ডাকাতির শিকার হয়েছেন নওগাঁ শহরের দক্ষিণ কালিতলা মহল্লার ব্যবসায়ী সঞ্জয় কুমার দাস।

সেই ভোরের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিনের মতো ওইদিন ভোরে বাবা পূজার ফুল নিতে বাড়ির গেট খুলেছিলেন। ওই মুহূর্তে ওত পেতে থাকা ডাকাত দল বাবাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে প্রথমে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর ৬ জন ডাকাত আমাদের সবাইকে জিম্মি করে ২০ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ ৩০ হাজার টাকা ও ব্যবহৃত ২টি স্মার্টফোন লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ লিখিত অভিযোগের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও লুট হওয়া মালামাল উদ্ধারসহ জড়িতদের আটকে পুলিশের দৃশ্যমান ভূমিকা নেই।

ব্যবসায়ী সঞ্জয় কুমার দাস বলেন, আমার বাড়িতে ডাকাতির দুই দিন পর পার নওগাঁ মহল্লার হাজীপাড়ায় আরও একটি ডাকাতি হয়েছে। সেখানেও একই কায়দায় ১০ মিনিট সময়ের মধ্যেই একটি পরিবারের সর্বস্ব লুট করে নিয়েছে ডাকাতরা। ওই দিনের সিসিটিভি ফুটেজ আমাকে দেখিয়েছে পুলিশ। তবে কার্যত কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যেকটা ঘটনাস্থলই সদর মডেল থানা থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। আমার বাড়ির পাশেই পুলিশ ফাঁড়ি। একের পর এক ডাকাতি হচ্ছে, অথচ পুলিশ কোনো আসামিকে এখনো ধরতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতির ঘটনা শুধু কালিতলা এবং হাজীপাড়াতেই ঘটেনি, এ ঘটনার ১১ দিন আগে ১৮ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে শহরের চকমুক্তার মহল্লায় একই ধরনের ভয়াবহ ডাকাতির কবলে পড়ে সিঙ্গাপুর প্রবাসী লিটনের পরিবার। তার বাড়িতেও একই কায়দায় প্রবেশ করেছিল ডাকাত দলের ৪ সদস্য। নওগাঁ সদর মডেল থানা থেকে এই বাড়ির দূরত্ব ৫০০ মিটারের মধ্যেই।

প্রবাসী লিটনের স্ত্রী সুরভী আক্তার বলেন, অসুস্থ শাশুড়ি ও এক সন্তানকে নিয়ে দুই বছর যাবত শহরে নিজেদের এই বাড়িতে উঠেছি। কিছুদিন আগে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাজে সহযোগিতার জন্য গ্রাম থেকে বিশ^স্ত এ মেয়েকে সঙ্গে রেখেছিলাম। ঘটনার দিন ওই মেয়ের স্বামী ঢাকা থেকে নওগাঁয় আসলে ভোরে গেট খুলতে যায় তার স্ত্রী। তখনই ডাকাতরা ভেতরে ঢুকে সোজা চতুর্থ তলায় আমার ফ্ল্যাটে চলে আসে। এরপর সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে প্রায় ১১ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ও ১টি স্মার্টফোনসহ সর্বস্ব লুট করে নিয়ে চলে যায়। সিসিটিভি ফুটেজে ৪ ডাকাতের মধ্যে একজনের মুখ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। অথচ পুলিশ এখনো কাওকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

শুধু ডাকাতিই নয়, সম্প্রতি নওগাঁ সদর উপজেলায় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করেছে চুরি ও ছিনতাই। শহরের বিভিন্ন এলাকায় রাতভর বসছে জুয়ার আসর। যা রিতিমতো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে। সম্প্রতি চুরি, ডাকাতি ও জুয়ার আসরের বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের হাতে। 

সূত্র অনুযায়ী, সদর উপজেলার হাঁসাইগাড়ী বিলে ভাসমান নৌকা, ছোট যমুনা নদীর ভাসমান নৌকা, তিলকপুর ইউনিয়নের ছিটকীতলা মোড় এবং শহরের বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকার পুরাতন টার্মিনাল ভবনে প্রতিরাতেই জমজমাট জুয়ার আসর বসছে। জুয়ার আসর চালানোর নেপথ্যে মদদ দিচ্ছেন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহরের বালুডাঙ্গা বাসস্টান্ড এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিদিন রাত ১০টা বাজলেই পুরাতন টার্মিনাল ভবনে ভিড় জমায় জুয়াড়িরা। এখানে ছোট থেকে বড় সব ধরনের জুয়ার আসর চালানো হয়। যেখানে লাখ লাখ টাকা পকেটে নিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফেরেন অনেকে। পুলিশ মাঝে মধ্যে এখানে এসে টাকা নিয়ে ফিরে যায়। পুলিশের এমন ভূমিকার কারণে স্থানীয়রাও এখন প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।

শহরের পার নওগাঁ মহল্লার প্রত্যাশা ক্লিনিকের ব্যবস্থ্যাপনা পরিচালক সামিহা ইবনাত ইনিয়া বলেন, রোববার (৬ অক্টোবর) সকালে আমাদের ক্লিনিকে বাচ্চাকে সঙ্গে এনে এক মহিলা ভেতরে প্রবেশ করেছিল। ভেতরে ঢুকে সে ১টি স্মার্টফোন চুরি করে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। পরে ঘটনাটি সিসিটিভি ফুটেজে রেকর্ড পেয়েছি। এভাবে প্রকাশ্যে চুরি আগে কখনো হয়নি।

নওগাঁ জেলা স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম রাজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত তিন সপ্তাহে শহরের ভেতরেই ৩টি ডাকাতির ঘটনা ঘটলো। যা স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ সর্ব মহলে চরম অস্বস্তি ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি রাতেই নিজেদের দোকানঘর পাহাড়া দিতে হচ্ছে। এখনই এসব ডাকাতদের থামানো না গেলে আগামীতে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। তাই শহরে মডেল থানা পুলিশের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর নওগাঁ সদর মডেল থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগদান করেন নুরে আলম সিদ্দিকী। তার যোগদানের পর থেকেই চুরি ও ডাকাতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। জুয়ার আসর থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। এতেই উপজেলাজুড়ে ক্রমাগত অবনতি ঘটছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে এই পুলিশ কর্মকর্তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদক ও জুয়ার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কোথাও জুয়ার আসর বসানোর তথ্য আমাদের জানা নেই। কেউ সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে তাৎক্ষণিক জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। থানার কোনো পুলিশ সদস্য জুয়ার আসর থেকে সুবিধা নিয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নুরে আলম সিদ্দিকী আরও বলেন, ডাকাতির ঘটনায় ইতোমধ্যে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ডাকাতির ধরণ দেখে নতুন কোনো দল মনে হচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি ডাকাতদের শনাক্তে ডিবির টিমও কাজ করছে। সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে লুট হওয়া মালামাল উদ্ধারসহ জড়িতদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে পুলিশ।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কথা অস্বীকার করেছেন নওগাঁর পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে পুলিশের পেট্রোলিং টিম বাড়ানো হয়েছে। এতে অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশেই কমে আসবে বলে আশা করছি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রতিটা ডাকাতির ঘটনায় জড়িতদের শনাক্তে কাজ করছে পুলিশ। ইতোমধ্যে এক ডাকাতের ছবি জেলা পুলিশের ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট করা হয়েছে। ওই ডাকাতের পরিচয় জানালে ৫ হাজার এবং ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অপরাধীদের অল্প সময়ের মধ্যেই আইনের আওতায় আনা হবে।

আরএআর