বাবা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতেন। মা ছিলেন গৃহিণী। মাদকাসক্ত বাবার সঙ্গে মায়ের বনিবনা ছিল না। প্রায়ই দুজনের ঝগড়া হতো। ঝগড়ার একপর্যায়ে রাগের বশে মা বিষ পান বেছে নেন মৃত্যুর পথ। এ ঘটনার কিছুদিন পর বাবা মাদক নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান জেলে। এসবের মধ্যেই স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিধ্বস্ত হয়েছে বসতঘরটিও। একচালা চাপা টিনের ঘরে তিন শিশুকে নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছেন তাদের দাদি লিলুফা বেগম। নাবালক ওই শিশুগুলোর বেঁচে ওঠার আগেই যেন এখন মরণদশা।

হৃদয়বিদারক ঘটনাটি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকার। বৃহস্পতিবার (০৩ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকা পোস্টকে এসব তথ্য জানান শিশু তিনটির প্রতিবেশীরা।

স্থানীয়রা জানান, বুড়বুড়িয়া এলাকার রফিক মিয়ার ছেলে অটোরিকশা চালক সাব্বির হোসেনের (৩৫) সঙ্গে এক যুগ আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় পাশের বাজেবাচ্চর এলাকার বৃষ্টি আক্তারের। সাব্বির তার স্ত্রীকে প্রায়ই মারধর করতেন। বিয়ের পরের বছর তাদের কোল জুড়ে মেয়ে শিশুর জন্ম হয়। সেই শিশুর নাম রাখা হয় সিনথিয়া। বিয়ের পর থেকেই পারিবারিক কলহ বেঁধেই থাকত তাদের। এসবের মধ্যেই একে একে তাদের ঘরে আসে তিন শিশু।

তিন শিশুর মধ্যে বড় সন্তান সিনথিয়া এখন বুড়বুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। দ্বিতীয় শিশু জেসিকা আক্তারের বয়স ৩ বছর। দুই কন্যাশিশুর পর ওই দম্পতি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। তার নাম রাখা হয় মো. ইরফান। ইরফানের বয়স এখন ১ বছর।

ইরফানের বয়স যখন ৫ মাস, সাব্বির-বৃষ্টি দম্পতির মাঝে পারিবারিক বিষয় নিয়ে একদিন ঝগড়া বাঁধে। ঝগড়ার পর ঘর থেকে বেরিয়ে যান অটোরিকশাচালক সাব্বির। তিনটি শিশুর মায়া ভুলে গিয়ে রাগের বশে বিষপান করেন বৃষ্টি। পরে স্থানীয়রা টের পেয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক বৃষ্টিকে মৃত ঘোষণা করেন।

বৃষ্টির আত্মহত্যার কিছুদিন পর তার স্বামী সাব্বির মাদকসহ পুলিশের হাতে আটক হন। পরে পুলিশের করা মাদক মামলায় জেলে যান সাব্বির। এখন পর্যন্ত জেলেই আছেন তিনি।

মায়ের মৃত্যু পর বাবার কারাগারে যাওয়া নাবালক ওই শিশু তিনটির জীবন জ্বলে ওঠার আগেই যেন নিভে গেছে। দুধের শিশু ইরফান, ৩ বছরের জেসিকা আর ১০ বছরের সিনথিয়ার আশ্রয় এখন ৫৫ বছরের দাদির কোলে। বয়োবৃদ্ধ দাদি লিলুফা বেগম শিশু তিনটিকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তবে প্রতিবেশীরাও তাদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখেন বলে জানা গেছে।

গত ২২ আগস্ট রাত ১২টার দিকে ভারতের উজানের পানির স্রোতে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। ভেঙে যাওয়া বাঁধের বুড়বুড়িয়া এলাকার শতশত ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এ সময় বানের পানিতে ভাসিয়ে নেয় সাব্বিরদের ঘর। সাব্বিরের নাবালক ওই শিশু তিনটিকে নিয়ে তার মা লিলুফা বেগম বিপাকে পড়েছেন।

লিলুফা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাচ্চা তিনটিকে নিয়ে খুব বিপাকে আছি। সবচেয়ে বেশি কান্নাকাটি করে ১ বছরের শিশুটি। তার দুধ খাওয়া অবস্থায় মা আত্মহত্যা করেছে। মা ছাড়া এই বয়সের একটি বাচ্চা কেমন যন্ত্রণা দেয় সেটা তো বুঝেনই। তার মধ্যে শিশুগুলোর বাবা জেলে। কিছুদিন আগে বন্যায় থাকার ঘরটি ভেঙে নিয়ে গেছে। কী যে দুর্গতিতে আছি তা বলে বুঝানো যাবে না। সরকার যদি একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিত ছোট ছোট বাচ্চাগুলো নিয়ে একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই পেতাম।

তাদের প্রতিবেশী শিউলি বেগম বলেন, ছোট ছোট বাচ্চাগুলো নিয়ে খুব কষ্টে আছেন দাদি লিলুফা বেগম। আমরা প্রতিবেশী হিসেবে যতটা পারছি খেয়াল রাখছি। কিন্তু বাবা-মা ছাড়া নাবালক এই শিশুগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বন্যায় আমাদেরও দুটি ঘর ভেঙে গেছে। লিলুফা বেগমের ঘরও। আমাদেরকে যে সহায়তা করা হয়েছে তা পর্যাপ্ত না। সরকারের কাছে আমরা পুনর্বাসনের দাবি জানাচ্ছি।

বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ঘটনাটি এখনই শুনলাম। খোঁজ নিয়ে শিশু তিনটির দাদির সঙ্গে কথা বলব। তিনি যদি সম্মতি দেন আমি শিশু তিনটিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে এতিমখানায় হস্তান্তরের ব্যবস্থা করব। দাদি রাজি না থাকলে তাহলে অন্যভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করা হবে।

আরিফ আজগর/এফআরএস