বাস কিংবা পরিবহণ থেকে নামলেই দেখা যায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের দৃশ্য। তাই বলা হয়, ‘সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়ক পথে সুন্দরবন’। বাংলাদেশের ছয় জেলা জুড়েই সুন্দরবন বিস্তৃত। তবে একমাত্র সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ থেকে সরাসরি দেখা যায় এ বনের সবুজ আবহ। কিন্তু সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে নানা কারণে পর্যটক কমছে। এতে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন জীবিকায় ভাটা পড়েছে।

বনবিভাগ সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জ দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন ৫১ হাজার ৪৮০ জন দেশি ও ৫০ জন বিদেশি পর্যটক। যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছেন ৪০ হাজার ৯১৪ জন দেশি ও ১৮০ জন বিদেশি পর্যটক। ২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনে প্রবেশের মাথাপিছু ফি ছিল ২১ টাকা ৫০ পয়সা, যা পরে বাড়িয়ে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়।

সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পে জড়িত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায় এখানে পর্যটন কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে। তারা বলছেন, সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে পর্যটক কমার নেপথ্যে অন্তত তিনটি কারণ আছে। এগুলো হলো, সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কের বেহাল দশা, সুন্দরবনের প্রবেশ মূল্য বৃদ্ধি ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে সুন্দরবনে রাত্রিকালীন অবস্থানের পাশ দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকা।

যদিও বন বিভাগ বলছে, বর্তমানে অনলাইনে সুন্দরবনে প্রবেশের ফি প্রদান করে রিসিট জমা দিলে সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকেই সুন্দরবনে রাত্রিকালীন অবস্থানের পাশ দেওয়া সম্ভব।

সাতক্ষীরা শ্যামনগর এলাকার বাসিন্দা বেলাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ সুন্দরবনের ওপর অনেক নির্ভরশীল। এই অঞ্চলের মানুষ পর্যটন খাতেই বেশি আয় করে থাকেন। রাস্তাঘাট সংস্কারের অভাব ও টুরিস্ট বোর্ডের ভাড়া বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের এই অঞ্চলে পর্যটক কমে গেছে। তবে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হলে আগে আমাদের প্রধান সড়কগুলো যেমন সাতক্ষীরা থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তাটি সংস্কার করা খুবই জরুরি। সুন্দরবনে ২-৩ দিন বা রাত্রিকালীন অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে রেঞ্জ অফিসের সে ক্ষমতা না থাকায় পর্যটকদের এ অঞ্চলে আসার আগ্রহ অনেক কমে গেছে। মূলত রাত্রিকালীন পাশ আনতে খুলনায় যেতে হয়, এটা পর্যটকদের কাছে একটা বিড়ম্বনা। রাত্রিকালীন পাশ পারমিট চালু হলে এই অঞ্চলে পর্যটক অনেক বাড়বে।

উন্নয়নকর্মী স.ম ওসমান গণী সোহাগ বলেন, আমি উপকূলীয় অঞ্চলের একজন সন্তান। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অঞ্চলে টুরিস্টরা প্রবেশ করে সেটা দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত। ২০১৬ সালে পর্যটন বর্ষ ঘোষণার পর টুরিস্টদের ব্যাপক একটি চাপ ছিল। পরবর্তীতে করোনার কারণে দীর্ঘদিন সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ থাকায় টুরিস্টদের সেই চাপ কমে যায়। তারপর থেকেই সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে পর্যটক কমে যাচ্ছে। পর্যটক কমার কারণ হিসেবে আমরা যে কারণগুলো উল্লেখ করব তার মধ্যে প্রথম এবং প্রধানতম কারণ হচ্ছে সাতক্ষীরা থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত সড়কের বেহাল দশা। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে টুরিস্টরা মোংলা বা পূর্ব সুন্দরবনে সহজেই প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু সেই তুলনায় মুন্সিগঞ্জে এসে পৌঁছাতে অনেকটা সময় লাগে আর সেই সঙ্গে আছে সড়কের বেহাল দশা।

সংবাদকর্মী শেখ তানজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের একমাত্র জেলা সাতক্ষীরা যেখান থেকে সড়কপথে সুন্দরবন উপভোগ করা সম্ভব। কিন্তু সাতক্ষীরা থেকে মুন্সিগঞ্জের প্রধান সড়কটির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ও জরাজীর্ণ। এখন ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় আসতে সাড়ে চার ঘণ্টা সময় লাগে। আর সাতক্ষীরা থেকে মুন্সীগঞ্জ আসতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। যেমন সড়কের অবস্থা, তেমনি এ সড়কের পরিবহণ ব্যবস্থা। সড়কটি আগু সংস্কার করে চার লেনে প্রশস্ত করা হলে এবং সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কে সরাসরি পর্যটকবাহী বাস চলাচলের উদ্যোগ নিলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের পরে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অঞ্চলে আশংকাজনক হারে পর্যটক কমে যাওয়ায় পর্যটন ব্যবসায়ী, গাইড, ট্রলার মালিক ও স্থানীয় হোটেল রেস্তোরাঁর মালিকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। সুন্দরবনের প্রবেশ ফি বৃদ্ধিও পর্যটক কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ।

সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গেলে অবশ্যই সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কের উন্নয়ন করতে হবে। আর সুন্দরবনের প্রবেশ ফি বাড়ানো কমানোর বিষয়টি সরকারের। তবে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে রাত্রিকালীন পাশের জন্য অনলাইনে টাকা জমা দেওয়া যাচ্ছে। টাকা দিয়ে পেমেন্ট স্লিপ দেখালেই পাশ করে দেওয়া যাবে।

এফআরএস