গেলো চার দিনে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যাকবলিত শেরপুর। যেদিকে তাকানো যায় শুধু পানি আর পানি। পিচঢালা রাস্তার পাশে এমন পানি ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়লেই হিট। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে ঘুরতে যাওয়া বা ছবি তোলা দেখে মনে হচ্ছে এ যেন কোনো ‘পিকনিক স্পট’।

দিনের যে সময়টাতে বৃষ্টি থাকছে না তখন শেরপুর জেলা শহর থেকে ঝিনাইগাতী, তিনানী ও নালিতাবাড়ী সড়কে বাইক, প্রাইভেটকার নিয়ে ভিড় করছেন উৎসুক মানুষ। এতে করে রাস্তায় জ্যাম সৃষ্টি হওয়ায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবীদের পিকআপভ্যান-ট্রাকগুলো পড়ছে বিপাকে। জ্যামে আটকে থাকতে হচ্ছে তাদের।

অনেকেই আবার বন্যাদুর্গত এলাকায় ফেসবুক ও ইউটিউবের জন্য কন্টেন্ট, রিলস ও শর্টস বানাতে ভিড় করছেন। তাদের বেশিরভাগই অযাচিত প্রশ্ন করে বিরক্ত করছেন পানিবন্দিদের। এতে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষরা।

সোমবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে ঝিনাইগাতীর বিভিন্ন এলাকায় এসব মানহীন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিড় দেখা গেছে। অনেককে হাঁটু পানিতে নেমে ছবি তুলতেও দেখা গেছে।

রোববার (০৬ অক্টোবর) দুপুরে ঝিনাইগাতী উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী মশিউর রহমান সজীব। বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন এলাকার পর্যটকদের গাড়ির জ্যামে শেরপুর-ঝিনাইগাতী সড়কের কাটাখালী এলাকায় আটকা পড়েন তিনি। এ সময় তাদের ত্রাণবাহী ট্রাকটি অন্তত ১০ মিনিট সেখানে আটকে ছিল। এ সময় পর্যটকদের গাড়ির ভিড়ের পাশেই বন্যাকবলিত এলাকার দুই নারীকে ত্রাণের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখা যায়। সজীব জানান, এই সড়কটিতে কখনো জ্যাম হয় না। প্রশস্ত রাস্তায় একাধিক গাড়ি একসঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত ও অভারটেকিং করতে পারে। অথচ বন্যা দেখতে আসা উৎসুক মানুষদের গাড়ি এলোমেলো করে রাখার কারণে এই জ্যাম সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কারণে আমাদেরও আটকে থাকতে হচ্ছে।

একই সময়ে শেরপুরের বাইরে থেকে আসা আরও বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ত্রাণবাহী গাড়িও জ্যামে আটকে থাকতে দেখা যায়। মৈ ফাউন্ডেশনের নারী স্বেচ্ছাসেবী রাজিয়া খান বলেন, ‘আমরা আসলেই মানুষ না। হয়ত সুপার হিউম্যান, নয়তো জন্তু হয়ে গেছি। এই দুঃসময়েও মানুষ পানি দেখতে এসে অন্যের ভোগান্তি তৈরি করছে। আমরা ঢাকা থেকে সারাদিন জার্নি করে ত্রাণ দিতে এসেছি। এখন এই রাস্তায় জ্যামে আটকে আছি। এটা আসলেই দুঃখের বিষয়। মানুষ এই দুঃসময়েও কীভাবে এত আনন্দ করতে পারে?’

বন্যাকবলিত ঢিঘির পাড় এলাকার হুমায়ুন মিয়া বলেন, ‘রাস্তা তলাইয়া গেছে। বাড়ি ঘরে পানি উঠছে। না খাইয়া আছি ক’দিন ধরে। কোনো ত্রাণের খবর নাই। অথচ বাড়ির সামনের ব্রিজে সারাদিনই পুলাপানের ভিড়। সবাই ছবি তুলতাছে, ভিডিও বানাইতাছে। বাড়িত পানি উঠছে, বাড়ির মহিলারা সামনের ব্রিজে যাইয়া একটু বসবো, সেই সুযোগটাও নাই।’

দাড়িয়ারপাড় এলাকার সুমন আহমেদ বলেন, ‘আমরা না খাইয়া থাকি আর বাড়ির সামনের রাস্তায়, ব্রিজে মানুষ পিকনিক করতে আসে।’

উল্লেখ্য, টানা চারদিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে শেরপুরের পাঁচ উপজেলা। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েন দুই লাখের বেশি মানুষ। পৌনে দুই লাখ কৃষকের প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে এবারের বন্যায়। তিন হাজার মাছের ঘের ভেসে গিয়ে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। বন্যার কারণে জেলার ২৪২টি প্রাথমিক ও ৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন।

যদিও সোমবার সকাল থেকে ঝিনাইগাতী উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পার্শ্ববর্তী নকলা ও নালিতাবাড়িতে এখনো বাড়িঘরে পানি আছে। জেলাজুড়ে পানিবন্দিদের উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ কার্যক্রমে প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে স্থানীয় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা।

এছাড়া ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উদ্ধার কাজ করতে ও ত্রাণ নিয়ে শেরপুরে এসেছেন।

নাইমুর রহমান তালুকদার/এফআরএস