কয়দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন। এতে করে ভোগান্তিতে পড়েছেন প্লাবিত ৫০টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

পাশাপাশি তীব্র স্রোতে ভেঙে যাওয়া রাস্তা ও বসতবাড়ি নিয়ে বিপাকে রয়েছেন পানিবন্দি মানুষজন। পানির তোড়ে ভেসে গেছে অনেক বসতভিটার মাটি ও আসবাব পত্র।

সোমবার (৭ অক্টোবর) জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সোমেশ্বরী ও কংস নদীর পানি দূর্গাপুর ও জারিয়া পয়েন্টে কমেছে তবে উপদাখালী নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলার কলমাকান্দা উপজেলায় রংছাতি ইউনিয়নের পাঁচগাও এলাকায় তিন কিলোমিটার রাস্তা পানির স্রোতে বেশ কিছু জায়গায় ভেঙে গেছে। এতে করে ওই এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের পাঁচগাঁও এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের ঢল কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হলেও কলমাকান্দা থেকে পাঁচগাঁও বর্ডার রোড পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রাস্তার বেশ কিছু জায়গা ভেঙে গেছে। এতে করে কলমাকান্দার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া সড়কের বিভিন্ন অংশে বড় বড় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ওই এলাকার মানুষ।

এদিকে মানুষ হাঁস, মুরগি ও গবাদি পশু নিয়েও পড়েছেন বিপাকে। এছাড়া উঠতি আমন ফসল ও পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক ও মাছের খামারিরা। তারা বলছেন কয়েক ঘণ্টার পাহাড়ি ঢলে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

পাঁচগাও এলাকার বাসিন্দা মো. আবুল বাশার বলেন, পাঁচগাও বাজার থেকে বর্ডার রোড পর্যন্ত তিন জায়গায় রাস্তা ভেঙে গেছে। এই এলাকার জনগণ খুব কষ্টে চলাফেরা করছে। পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টির কারণে এলাকার মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। কারো ঘরে বুক পানি, কারো ঘরে কোমর পানি, কারো চুলায় পানি, কেউ রান্না করে খেতে পারছে না। সবাই এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ান। এখানে শুকনো খাবারের অভাব রয়েছে, গো-খাদ্যের অভাব রয়েছে। আমাদের ফসলের জমি তলিয়ে ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। পানি এখন একটু কমলেও বৃষ্টি হলে আবার বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

একই গ্রামের বাসিন্দা মো. মোস্তাকিম এলাহী বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা দেখি আমাদের সমস্ত কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঘর-দোর সব ভেঙে গেছে। এখন আমরা খুব দুর্ভোগের মধ্যে বসবাস করছি, চলাফেরা করার কোনো পরিস্থিতি নাই। আমাদের খাবারের অভাব বিদ্যুৎতের নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। যে যেভাবে পেরেছে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ অন্য লোকজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।

ঢলের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সুলতানা রাজিয়ার ঘরের সব আসবাবপত্র। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি। ঘরবাড়ি ভেঙে চলে গেছে, হাঁস-মুরগি ছিল এগুলো বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের ঘরে পানি তাই বাচ্চাদের নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আপনাদের মাধ্যমে যদি কোনো সহযোগিতা পাই তাহলে হয়তো আমাদের একটু উপকার হবে।

বাগবের গ্রামের বাসিন্দা মো. রতন মিয়া বলেন, এ রাস্তা যদি অচিরেই নির্মাণ না হয় তাহলে জনগণের খুব ভোগান্তি হবে। প্রায় লক্ষাধিক লোক যাতায়াত করে এই রাস্তা দিয়ে। এটা দিয়ে আমাদের এলাকার লোকজন ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের সাথে যাতায়াত করে থাকে। কিন্তু এই পানির স্রোতে রাস্তা ভেঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মানুষের অনেক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

৮নং রংছাতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান পাঠান বাবুল বলেন, আমাদের সার্বিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বিশেষ করে মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলের যে পানি এসেছে সেটা প্রথমে আঘাত করেছে আমার ইউনিয়নে। পাশাপাশি পাঁচগাঁও টু কলমাকান্দার যে রাস্তা সেটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় অনেক গভীর গর্তের তৈরি হয়েছে। আমাদের হাজার হাজার একর জমি এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কলমাকান্দা উপজেলার আটটি ইউনিয়নে বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে, তবে মানুষজন এখনো পানিবন্দি হয়নি। আমরা আমাদের সবগুলি ইউনিয়নের প্রতিটা স্পটেই সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও নজরদারি রাখছি। কারো যদি আশ্রয়স্থল প্রয়োজন হয় অথবা ত্রাণের প্রয়োজন হয়, আমরা তা নিয়ে প্রস্তুত আছি। আমাদের উপজেলায় ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া আমাদের কন্ট্রোল রুম রয়েছে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার জন্য। পাশাপাশি বেশ কয়েক জায়গায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমরা তথ্য পেয়েছি। ক্ষতিগ্রস্থ সড়কগুলো দ্রুত মেরামত করার ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। আমরা আশা করি সকল বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগে এই দুর্যোগকালীন সময়টা সুন্দরভাবে মোকাবেলা করতে পারব।

চয়ন দেবনাথ মুন্না/আরকে