নারায়ণগঞ্জে এক মাসে ২৫ মরদেহ উদ্ধার
নারায়ণগঞ্জে গত সেপ্টেম্বর মাসে বেড়েছে মরদেহ উদ্ধারের সংখ্যা। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ২৫টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২৫টি মরদেহের মধ্যে হত্যাকাণ্ডে সাতজন, ১৬ জনের অপমৃত্যু এবং সড়ক দুর্ঘটনায় দুইজনের মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যে, গত ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুরে বউবাজার সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন পুকুর থেকে সিফাত (২০) নামের এক এইচএসসি ফলপ্রত্যাশী ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সিফাত শহরের খানপুরের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল সংলগ্ন দন্ত চিকিৎসক সোহেল মল্লিকের ছেলে। ওই দিনই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ এলাকার ডকইয়ার্ড থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। স্থানীয়রা মরদেহটি দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়।
বিজ্ঞাপন
এর পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের বন্দরের দড়ি সোনাকান্দা এলাকায় চোর আখ্যা দিয়ে পল্টন মিয়া (৩৫) নামের এক মানসিকপ্রতিবন্ধী যুবককে হত্যার ঘটনা ঘটে। নিহত পল্টন মিয়া (৩৫) বন্দরের দড়ি সোনাকান্দা এলাকা সাইদুল ইসলামের ছেলে।
গত ৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তেতলাবো এলাকায় পরকীয়া সন্দেহে স্ত্রী-সন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করে নুরুজ্জামান আনিছ। নিহতরা হলেন- বরগুনার আমতলী থানাধীন তারিকাটা এলাকার শাহজাহান হাওলাদারের মেয়ে রোকসানা (৩০) বেগম এবং নুরুজ্জামান আনিছের মেয়ে জান্নাত (৫)। একইদিন বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ডস্থ বাংলাদেশ নবজাতক হাসপাতালের ভুল চিকিৎসায় এক নবজাতক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। নিহত নবজাতক শিশুর বাবার নাম লিমন। তিনি ৯নং ওয়ার্ডস্থ জালকুড়ি এলাকার শহীদ মালেকের বাড়ির ভাড়াটিয়া।
এরপর ৮ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের হেফাজতে থাকা সৈয়দুল করিম (৫৫) নামে এক বৃদ্ধ ব্যক্তির রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সৈয়দুল করিম কক্সবাজার জেলার নুরুল কবিরের ছেলে।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ফতুল্লার বিলাশ নগর এলাকায় এলজিডি কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে শামীম (১৮) নামের এক গার্মেন্টস শ্রমিক খুন হন। নিহত শামীম ফতুল্লার ইসদাইর সুগন্ধা আবাসিক এলাকার সাগর ভিলার দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটের জনুব আলীর ছেলে।
পরদিন ১১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় নিমাইকাশারী এলাকায় নুপুর আক্তার (২৫) নামের এক অন্তঃসত্ত্বা নারী গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। নিহত নুপুর আক্তার বরিশালের হিজলা থানার বাসিন্দা মো. রাসেল মালের স্ত্রী। একইদিন চাষাঢ়ায় চলন্ত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে অজ্ঞাত এক যুবকের মৃত্যু হয়। সেদিনই নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের একটি খালি জায়গায় ছুরিকাঘাতের শিকার হয়ে ফকির গার্মেন্টসের শামীম (২২) নামের এক শ্রমিক নিহত হন।
গত ১২ সেপ্টেম্বর আড়াইহাজারের হাইজাদি ইউনিয়ন কাহিন্দী এলাকার নিজ বাড়ির পাশের বাঁশঝাড় থেকে তানজীলা আক্তার (১৮) নামের এক বাকপ্রতিবন্ধীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত তানজীলা হাইজাদি ইউনিয়নের সরফত আলীর মেয়ে।
এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের বন্দরের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জাঙ্গাল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় তাহসিন নামের আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সী এক মোটরসাইকেলচালকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আরও এক মোটরসাইকেল আরোহী আহত হন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মৌচাক এলাকায় আবু বকর সিদ্দিক (৩৮) নামের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শকের (এএসআই) মৃত্যু হয়। নিহত আবু বক্কর সিদ্দিক দিনাজপুর সদরের কমলপুর ইউনিয়নের দানিহারী ডোলপাড়া এলাকার আশরাফ আলীর ছেলে।
আরও পড়ুন
পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানা সড়কের পাশে আয়েশা আমজাদ হাসপাতালের পাশের খাল থেকে এক অজ্ঞাত যুবকের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে বৈদ্যেরবাজার নৌ-পুলিশ।
গত ২২ সেপ্টেম্বর সোনারগাঁয়ে ফাতেমা বেগম নামের এক পঞ্চাশোর্ধ নারীকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগ উঠে জামাতা নান্টু মিয়ার বিরুদ্ধে। উপজেলার এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের বস্তুল এলাকা থেকে ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করে তালতলা ফাঁড়ি পুলিশ। নিহত ফাতেমা বেগম নারায়ণগঞ্জের বন্দরের দশদোনা গ্রামের আব্দুল করিমের স্ত্রী।
এরপর ২৫ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে নূপুর আক্তার (২৬) নামের এক গৃহবধূকে গলায় ওড়না দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নুপুর আক্তারের স্বামী মো. রবিউল ইসলাম বাবুকে আটক করেছে পুলিশ। নিহত নুপুর বরিশালের শাহজাহান চৌকিদারের মেয়ে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতাল থেকে মোবারক (৬৭) নামের এক বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার করে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ।
পরদিন ২৭ সেপ্টেম্বর বন্দরের কলাগাছিয়া ইউনিয়নের উত্তর সাবদী এলাকায় নিখোঁজের তিন দিন পর অনিক (২০) নামের এক যুবকের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত অনিক বন্দরের সেলসারদী গোসাইবাড়ি এলাকার নাসিরউদ্দিনের ছেলে। একইদিন বন্দরের উত্তর সাবদি এলাকায় অনিক (১৮) নামের এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত অনিক বন্দরের সেলসারদি গোসাইবাড়ি এলাকার নাসির উদ্দিনের ছেলে। সেদিনই ফতুল্লার কুতুবপুরে দেলপাড়া টাওয়ার এলাকায় বাদল মিয়ার বাড়ির পেছনে পানিতে ডুবে হাসান (১৯) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত হাসান শরীয়তপুর জেলার জাজিরা থানার বেতনা গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে।
এদিকে ২৯ সেপ্টেম্বর রূপগঞ্জের পূর্বাচলের ৩নং সেক্টরের লেকের পানিতে ডুবে মুসা নামের ৫ বছরের এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। নিহত মুসা পিতলগঞ্জের বাসিন্দা আনোয়ারুলের ছেলে। একইদিন ফতুল্লায় একটি বহুতল ভবনে নির্মাণকাজ করার সময় ভবন থেকে পড়ে হাসিব মিয়া (১৯) নামের এক নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ফতুল্লার ভোলাইল এলাকায় এনআর গ্রুপের একটি তৈরি পোশাক কারখানার নির্মাণাধীন দশতলা ভবনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত হাসিব মিয়া চাপাই নবাবগঞ্জের শিবপুর ইউনিয়নের ছোট সুরতাপুর গ্রামের আব্দুল নেওয়াজ ছেলে।
সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের বর্জ্য ডাম্পিং জোনের পাশ থেকে এক নবদম্পতির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তারা হলেন মিজমিজি দক্ষিণপাড়া এলাকার মনির হোসেনের ছেলে শফিকুল ইসলাম (২৮) ও তার স্ত্রী রুমি (২৬)।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপমৃত্যুর বিষয়ে তো আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। বেশিরভাগ অপমৃত্যু পারিবারিক কলহের জেরে হয়। আর পারিবারিক কলহগুলো হয় অর্থনৈতিক দৈনতা, সামাজিক টানাপোড়ন ও পরকীয়ার ঘটনার কারণে। মূলত এসব কারণেই অপমৃত্যুগুলো হয়ে থাকে। এসব বিষয় তো আর এক দিনে সমাধান করা সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও কাউন্সেলিং।
সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। এ ছাড়া অনেকেই ট্রাফিক আইন মানে না। আবার কেউ অহেতুক রাস্তা পার হয়। কেউ বেপরোয়া গাড়ি চালায়। এসব কারণেই সড়ক দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। এজন্য সচেতনতার বিকল্প নেই।
হত্যার বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, আমি মনে করি নারায়ণগঞ্জ একটা মাল্টিডাইমেনশনাল শহর। এখানে বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন জায়গার মানুষ বসবাস করে। এজন্য খুনের ঘটনাগুলো ঘটে। তবে আমরা খুন প্রতিরোধে বিশেষ করে সংঘবদ্ধ কোনো ঘটনা ঘটলে তার জন্য সচেতন আছি। যেখানেই খুনের ঘটনা ঘটছে সেখানেই আমাদের পুলিশ তাৎক্ষণিক রেসপন্স করছে। আমরা খুনি বা আসামিদের ধরার ব্যাপারে একবারে জিরো টলারেন্স, অনেককেই ধরে ফেলেছি। এ ছাড়া অজ্ঞাত আসামিদের ধরার জন্যও আমাদের কার্যক্রম চলছে। খুনিদের ব্যাপারে আমাদের কোনো ছাড় নেই।
এমজেইউ