ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সকল আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে রংপুরের মানুষ ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে। প্রতিবছর বর্ষা ও খরা মৌসুমে তিস্তা নদী মানুষের দীর্ঘশ্বাস ভারী করছে। এর থেকে পরিত্রাণে তিস্তা কর্তৃপক্ষ গঠন করে নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও ভারতের কাছ থেকে সকল অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে উন্নয়ন বৈষম্যে পিছিয়ে পড়া তিস্তাপাড়ের মানুষ।

আন্দোলনের অংশ হিসেবে বুধবার (২ অক্টোবর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার তিস্তাপাড়ের ১২ উপজেলায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কর্মসূচি থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। এদিন তিস্তা অববাহিকা উন্নয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিসহ ভারতের উজানের ঢলে রংপুর বিভাগে সৃষ্টি আকস্মিক বন্যার প্রতিবাদ জানানো হয়।

কর্মসূচিতে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় অংশ নেন তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী, স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য মশিয়ার রহমান, কেন্দ্রীয় নেতা মোশাররফ মুনশি, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য বখতিয়ার হোসেন শিশির, কেন্দ্রীয় নেতা মোশাররফ হোসেন, মওলানা আব্দুস সালাম, মওলানা এস এম, জাহিরুল, রাজিকুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট চিত্তরঞ্জন, রংপুরের গংগাচড়ায় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য আব্দুর নূর দুলাল, ছাদেকুল ইসলাম, মাহমুদ আলম, কাউনিয়ায় কেন্দ্রীয় নেতা মোস্তাফিজার রহমান, আশিকুর রহমান, পীরগাছা উপজেলায় কেন্দ্রীয় নেতা বাবুল আকতার, শহিদুল ইসলাম সাজু, রফিকুল ইসলাম।

এ ছাড়া লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার কর্মসূচিতে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান, কেন্দ্রীয় নেতা ওসমান গণি বাদশা, মশিউর রহমান, কালীগঞ্জ উপজেলায় কেন্দ্রীয় নেতা ড. মনোয়ারুল ইসলাম, আমিরুল ইসলাম হেলাল, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক, আদিতমারী উপজেলায় কেন্দ্রীয় নেতা দেলোয়ার হোসেন ইঞ্জিনিয়ার, দীলীপ কুমার রায়, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম মোস্তফা, হাফিজার রহমান, জলঢাকা উপজেলায় ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম পাশা এলিচ, জাহাঙ্গীর আলম, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুন্সি সাজু, মমতাজুর রহমান বাবু প্রমুখ।

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, খরা, বন্যা ও প্রতিবছরের উপর্যুপরি ভাঙনে তিস্তা অববাহিকার ২ কোটি মানুষের জীবনে নেমে এসেছে মহাদুর্যোগ। ভাঙনে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার সরকারি-বেসরকারি সম্পদ, ঘরবাড়ি, ফসলিজমি, রাস্তাঘাট, হাটবাজার মূল্যবান অবকাঠামো পাগলা তিস্তা খেয়ে ফেলছে। হুমকিতে পড়েছে গোটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থী উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা। নদীভাঙনে বাড়ছে রংপুর বিভাগের গড় দারিদ্র্যের হার।

তিনি আরও বলেন, রংপুর অঞ্চলের মানুষের দুঃখগাথা একটি নদীর নাম তিস্তা। বালু ও পলি জমে তিস্তার বুক (মূলপ্রবাহ) সমতলের চেয়েও উঁচু হয়ে গেছে। ভাঙনের তাণ্ডবে নদীর প্রস্থ হয়েছে কোথাও কোথাও ৮-১০-১২ কিলোমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় দিনদিন পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে উঠেছে। খরাকালে তিস্তার দুই তীরের বিস্তৃত জনপদে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। তিস্তার মরণে তিস্তার শাখা ও উপনদীগুলো (২২ টি) হচ্ছে বেদখল, হচ্ছে তিস্তার সঙ্গে সংযোগ হারা। তিস্তা খনন ও তিস্তা সংযুক্ত শাখা প্রশাখা নদীগুলোর মুখ খুলে না দিলে ভাঙন ও উপর্যুপরি বন্যার হাত থেকে পরিত্রাণ মিলবে না।

পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান বলেন, ২৪০ বছর বয়সী নদী তিস্তার জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি কোনো খনন ও পরিচর্যা করা হয়নি। ২০১৪ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক নদী আইন প্রণীত হয়েছে। আইন অনুযায়ী ভারত তিস্তা নদীর পানি একতরফা প্রত্যাহার করতে পারে না। খরাকালে তিস্তার উজানে যতটুকুই পানি থাক তার ন্যায্য হিস্যাটাও আমাদের প্রয়োজন। ২০১৪ সাল থেকে শুষ্ক মৌসুমে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তিস্তার পুরো পানি একতরফা প্রত্যাহার করছে ভারত। উপরন্তু, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের অংশের তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতায় আরও তিনটি খাল খননের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে রংপুর বিভাগের সব আন্তঃসীমান্ত নদী জলশূন্য হবে। ইতিপূর্বে সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হওয়ার কারণে খরাকালে বাংলাদেশ অংশের তিস্তা বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তিস্তা আন্দোলন রংপুর বিভাগের উন্নয়ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণজাগরণে রূপান্তরিত হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে চীনের পাওয়ার চায়না ও পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প শীর্ষক সমীক্ষা কাজ ২০১৬-২০১৮ সালেই শেষ করে। ইআরডি বৈদেশিক সাহায্য অনুসন্ধান কমিটির সভায় সহজ শর্তে ঋণ পেতে প্রকল্পটি পাঠানো হলেও ভারতের আপত্তিতে তা আটকে যায়। এ নিয়ে শুরু হয় ভারত-চীন দ্বৈরথ। দুই দেশের রশি টানাটানিতে প্রকল্পটি তিস্তা চুক্তির মতো ঝুলে যায়। পরবর্তীতে তিস্তা প্রকল্পে ভারত অর্থায়নের ইচ্ছা ব্যক্ত করে একটি কারিগরি দল বাংলাদেশে পাঠানোর কথা বলে কালক্ষেপণ করছে। তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ ভারতের ওই কালক্ষেপণ ও দুর্ভিসন্ধির বিরুদ্ধে ৬ থেকে ১৩ জুলাই তিস্তার দুই তীরে সভা-সমাবেশ এবং ১১০টি স্থানে গণঅবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে।

পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য বখতিয়ার হোসেন শিশির বলেন, অন্য দেশ অথবা সংস্থা থেকে (চীন, ভারত, জাপান, বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ) সহজ শর্তে অর্থগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা থাকলে নিজস্ব অর্থায়নে ধাপে ধাপে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। চাইলে নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে প্রায় ১০-১২ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছরে খরচের জোগান দিতে হবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এর জন্য অভ্যন্তরীণভাবে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিস্তা অববাহিকার দুই কোটি মানুষ নিজেরাই যথেষ্ট। পাশাপাশি দেশবাসী ও বিদেশি বন্ধুরাও এই সামাজিক বিনিয়োগে অংশ নেবেন- এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এ কাজে সরকারি উদ্যোগে তিস্তা বন্ড চালু করলে মূলধন সংগ্রহের জন্য ব্যাংক অথবা বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরশীল হতে হবে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের বরাদ্দকৃত বাজেটের টাকার একটি অংশ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করার দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তার ইমেজকে কাজে লাগিয়ে দাতাসংস্থা ও প্রবাসীদের কাছ থেকে সহায়তা নিতে পারবেন। এই লক্ষ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা ‘তিস্তা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের প্রস্তাব করছি। বর্তমান সরকার ডাক দিলে শিক্ষার্থীসহ সাহসী তারুণ্য এ কাজে পাশেই থাকবে। রংপুর বিভাগ থেকে বৈষম্য দূরীকরণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দাবির মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিটির ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা অবগত রয়েছেন। আমরা মনে করি, তিস্তা প্রকল্প লাভজনক ও মানবিক প্রকল্প।

এদিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গজলডোবা বাঁধ খুলে রংপুর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টির প্রতিবাদ, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সকল আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিতুমীর কলেজে অধ্যায়নরত রংপুর বিভাগের শিক্ষার্থীরা সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।

প্রকৃতি ও জীবন ক্লাবের উপদেষ্টা হাসেম আলী বলেন, আমরা দেখেছি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনা রাষ্ট্রদূত রংপুরে এসেছিলেন, ভারতও এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেও হয়নি। নতুন সরকারের কাছে তিস্তা নদীবেষ্টিত উত্তরের ৫টি জেলার মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে। এ সরকার দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চর শংকদহের মতো এমন শত শত চর, কৃষিজমি, জীবন-জীবিকা রক্ষায় পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করছি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মাহমুদুল ইসলাম বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর্থিক প্রয়োজনীয়তা মেটাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স একটি মূল উৎস হিসেবে কাজ করবে। এর জন্য ‘তিস্তা বন্ড’ চালু করতে হবে, যা প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক ও এক্সপার্টদের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করবে। এ ছাড়া কূটনৈতিক ঝামেলামুক্ত থাকতে প্রকল্পের কাজ দেশীয় প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তিবিদ ও শ্রমিকদের দিয়ে করাতে হবে। এটি হলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো উন্নত হবে।

তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রংপুরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তাই সরকারের বিশেষ গুরুত্বের অংশ হিসেবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হোক। তিস্তা ব্যারাজ তৈরি করে উত্তরাঞ্চলে খরার সময় মঙ্গা দূর করা হয়েছে, তেমনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রাণ-প্রকৃতিকে ঠিক রেখে বাস্তবায়ন করা হলে এখানকার জনগোষ্ঠী আত্মনির্ভরশীল হবে এবং দেশের উন্নয়নকে চলমান রাখা সম্ভব হবে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ