পটুয়াখালীর ২১ ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক, গ্রামীণ নাগরিকদের ভোগান্তি
‘শেখ হাসিনা পালানোর পর চেয়ারম্যানও লাপাত্তা। তার কোনো খোঁজ নাই। কেউ কয় তিনি ঢাকায়, আবার কেউ কয় ইটালি। কিন্তু তার সঠিক ঠিকানা কেউ জানেন না। একটা প্রশংসাপত্র আর ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য তিনদিন ধরে আউলিয়াপুর ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দা বারান্দা ঘুরছি। পরে ইউপি সচিব আর প্যানেল চেয়ারম্যানের সাহায্যে কাগজ দুইটা পাইছি।’
ইউনিয়ন পরিষদে সেবা নিতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাগুলো জানাচ্ছিলেন আউলিয়াপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা জব্বার মৃধা।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আউলিয়াপুর, মাদারবুনিয়া, মরিচবুনিয়া, ছোটবিঘাই ও বড়বিঘাইসহ জেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের অবস্থাই এমন। অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর তারা গাঁ ঢাকা দিয়েছেন। এর ফলে সংশ্লিষ্ট ইউপির সেবা পেতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন গ্রামীণ নাগরিকরা। দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থাকলেও নানা বিড়ম্বনা ও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের।
তৃণমূলের সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি লাঘবের জন্য ওইসব ইউনিয়ন পরিষদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা এসিল্যান্ড এবং প্যানেল চেয়ারম্যানদের কাছে হস্তান্তর করেছে জেলা প্রশাসন। এলাকার মানুষের দাবি, এসিল্যান্ড নিজ দপ্তরের কাজে ব্যস্ত থাকায় নিয়মিত পরিষদে আসতে পারেন না। এতে নাগরিকদের ভোগান্তি আরও বেশি হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলায় মোট ৭৭টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ২১ জন ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক আছেন। কোথাও কোথাও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কিছু কিছু দলীয় মেম্বার ও মহিলা মেম্বারও আত্মগোপনে চলে গেছেন। এতে নাগরিক সেবা থেকে বিঘ্নিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তারা যথাসময়ে জন্ম সনদ, মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিকত্ব সনদ ও ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য সনদ ও প্রত্যয়নপত্র পাচ্ছে না।
পলাতাক চেয়ারম্যানদের ইউনিয়নগুলো হচ্ছে- পটুয়াখালী সদর উপজেলার ছোটবিঘাই, বড়বিঘাই, মাদারবুনিয়া ও মরিচবুনিয়া, বাউফলের কালাইয়া, বগা, কালিশুরি, চন্দ্রদ্বীপ, কনকদিয়া, কেশবপুর, ধুলিযা ও সূর্যমনি, দুমকীর লেবুখালী, আঙ্গারিয়া ও মুরাদিয়া, দশমিনার বহররমপুর ও দশমিনা সদর, রাঙ্গাবালীর ছোটবাইশদিয়া ও মৌডুবী, মির্জাগঞ্জের মাধবখালী ও কলাপাড়ার লতাচাপলি।
মঙ্গলবার (০১ অক্টোবর) সদর উপজেলার মরিচবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মো. মাসুম মৃধা অনুপস্থিত। তার অনুপস্থিতিতে সেখানে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও)। কিন্তু প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ততার কারণে তিনিও নিয়মিত পরিষদে উপস্থিত হতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এর ফলে নাগরিক সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়ছেন মানুষজন। অনেক লোকজনকে পরিষদের ভবনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আসাদুল হক বলেন, চেয়ারম্যান মাসুম মৃধা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনের বিশ্বস্ত কর্মী। সেই দাপটে উনি নির্বাচিত হয়ে এলাকার মানুষের ওপর অনেক জুলুম-নির্যাতন করেছেন। এ কারণে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তিনিও পালিয়ে যান। বর্তমানে পরিষদ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন ইউএনও। কিন্তু উনি সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাই নিয়মিত পরিষদে আসতে পারেন না। এতে নাগরিকরা সেবা থেকে ব্যাহত হচ্ছে।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইফফাত আরা জামান উর্মি বলেন, সদর উপজেলার চারজন চেয়ারম্যান অনিয়মিত ছিলেন। তাদের মধ্যে তিন ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মরিচবুনিয়া ইউপি সদস্যদের আভ্যন্তরীণ ঝামেলা থাকায় সেখানে আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা) জুয়েল রানা বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে জেলার ২১ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আত্মগোপনে আছেন। ওইসব ইউপির আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা এসিল্যান্ড এবং প্যানেল চেয়ারম্যানদের দেওয়া হয়েছে। এখানে নাগরিকদের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না। তবে, এটা সত্যি যে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা যেভাবে পরিষদে সময় দিতে পেরেছেন এবং সার্বক্ষণিক পরিষদে বসতে পেরেছেন, সেখানে প্রশাসনের লোক সেভাবে পারছে না। এখানে একটু তো সমস্যা থাকবেই।
মো. রায়হান/এফআরএস