শারদীয় দূর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মহালয়া। এ মহালয়া দিয়ে ক্ষণগণনা শুরু হয় সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার। সারা দেশের মতো পঞ্চগড়েও ২৯৯টি পূজা মণ্ডপে মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দূর্গাপূজার ক্ষণগণনা।

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নৌকাডুবির ঘটনায় ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আজ সেই বিভীষিকার মহালয়ার দিন।

সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের জানান, মহালয়ায় বাবা-মা হারানো হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে তাদের আত্মার শান্তি কামনায় অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় সেটিই মহালয়া। পুরাণ অনুযায়ী, মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। শিবের বর অনুযায়ী কোনো মানুষ বা দেবতা কখনো মহিষাসুরকে হত্যা করতে পারবে না। ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে এবং বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর হতে চায়। সবাই দুর্গোৎসবের সাজে মণ্ডপগুলোতে জড়ো হন শত শত পুন্যার্থী। সবার কণ্ঠে থাকে সুন্দর ও সুস্থ পৃথিবীর প্রত্যাশা।

বোদা উপজেলার বড় শশী ইউনিয়নে অবস্থিত সনাতন ধর্মীয়দের অন্যতম উপাসনালয় বোদেশ্বরী মন্দির। প্রাচীন প্রত্নতত্ত্বগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক এই মন্দির। ইংরেজ আমলে কোচ বিহারের এক রাজা ৩৫ ফুট দীর্ঘ ও ১৮ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। হিন্দু পুরাণের স্কন্দ অনুযায়ী, বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের আঘাতে দেবী দুর্গার দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়েছিল। যেখানে যেখানে দেবী দুর্গার শরীরের খণ্ড পড়েছিল, সেই জায়গাটিকে পীঠ বলা হয়। মন্দিরের দেওয়ালে ঝুলানো একটি চার্টে ৫১টি পীঠ স্থানের উল্লেখ আছে। বদেশ্বরীর এই পীঠে এখনো সংরক্ষিত আছে দেবী দুর্গার গোড়ালি। মহাপীঠ মন্দিরটি এখনও প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের নিদর্শন বহন করায় প্রতি বছর মহালয়া উৎসব ঘিরে বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নে উপলক্ষ্যে সারা দেশের হাজার হাজার পুর্ন্যার্থী ঐতিহাসিক বদেশ্বরী মন্দিরে পুজো উৎসবে যোগ দিয়ে থাকেন।

মন্দিরটিতে যেতে হলে তিন ইউনিয়নের নদীর পাড় থেকে নৌকায় করে পারাপার হতে হয়। সনাতন ধর্মের তিথি ও পঞ্জিকা অনুযায়ী এ বছর আজ (০২ অক্টোবর) থেকে শুরু হয়েছে মহালয়া। সে অনুযায়ী গত ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে বোদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দিরে মহালয়ায় অংশ নিতে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে সেতু না থাকায় নদী পার হতে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় চড়ে পুজো অর্চনা করতে যাচ্ছিলেন শতাধিকের বেশি যাত্রী। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ, নদীর স্রোত ও অব্যবস্থাপনার কারণে নৌকাটি মাঝপথে গিয়ে ডুবে যায়। ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় অনেককে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও ৭২ জনের প্রাণহানি ঘটে। নৌকাডুবিতে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক মৃতদের উদ্ধার করা না গেলেও কয়েকদিনের অভিযানে ৭১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তারপরেও এখনো একজন নিখোঁজের তালিকায় আছেন। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনার শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো পঞ্চগড়। নৌকাডুবির দুই বছর পূর্ণ হলেও এখনো নিহত স্বজনদের শোক কাটেনি। নৌকার ঘাটে এসে স্বজনকে মনে করে চোখের পানিতে বুক ভাসান।

স্মরণকালের নৌকাডুবির এ ঘটনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যাতে নিরাপদে মন্দিরে গিয়ে পূজা অর্চনায় অংশ নিতে পারেন, তা নিয়ে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন। এ নিয়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক সাবেত আলী আউলিয়া ঘাট পরিদর্শন করে মহালয়া উৎসব প্রস্তুতিমূলক সভা করেন। এ সভায় জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, বোদা ও দেবীধস প্রশাসন, সেনাবাহিনী, জেলা পরিষদ প্রধান, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের জনপ্রতিনিধি, পূজা কমিটির নেতারাসহ নিহত পরিবারের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।

মহালয়া উৎসবকে জাঁকজমকভাবে উদ্‌যাপনের লক্ষ্যে ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। মহালয়া ও পূজায় নিরাপত্তা ও সেবা প্রদানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, মন্দির কমিটি ও ছাত্র সংগঠন ‘আলোর পথে বাংলাদেশ থেকে ১০০ জন করে স্বেচ্ছাসেবী নিযুক্ত করা হবে। প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিরলস দায়িত্বপালনের নিরাপত্তার চাদরে মহালয়া উৎসবটি পালিত হবে এমনই জানিয়েছেন আয়োজকরা।

এসকে দোয়েল/এফআরএস