পটুয়াখালীর বাউফলে আব্দুর রশিদ সরদার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাইরুল আলমের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দিয়ে স্কুলটির সভাপতিকে চিঠি পাঠায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি)। বিষয়টি নিয়ে আইনি লড়াই চলার পর মাউশির আদেশ বৈধতা পেলেও অবৈধভাবে এখনও দায়িত্ব পালন করছেন সেই প্রধান শিক্ষক।

এর আগে মাউশির চিঠি পেয়েও সেই আদেশ উপেক্ষা করেছিলেন তৎকালীন সভাপতি। পরে মাউশির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন ওই প্রধান শিক্ষক। রিটে হাইকোর্টের আদেশ মাউশির বিপক্ষে গেলেও আপিল বিভাগের আদেশ পক্ষে আসে। কিন্তু সেই আদেশের পরেও মাউশির নির্দেশ বাস্তবায়ন হয়নি।

২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর তার নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দেয় মাউশি। সেদিনই মাধ্যমিক উইংয়ের সহকারী পরিচালক কাওছার আহমেদ সাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয় স্কুলের সভাপতিকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর খাইরুল আলমকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর চারদিন পরেই সেই নিয়োগ বাতিলের জন্য মাউশির মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন আটজন নিয়োগ প্রার্থী। আবেদনে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই দফা তদন্ত করে মহাপরিচালকের কাছে প্রতিবেদন পাঠান মাউশির বরিশাল অঞ্চলের উপ-পরিচালক। তদন্তে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়নি বলে জানানো হয়েছিল। পরে নিয়োগ বাতিল করে চিঠি দেওয়া হয়।

প্রধান শিক্ষক খাইরুল আলমের নিয়োগ বাতিল সংক্রান্ত মাউশির ওই চিঠি উপেক্ষা করেন সভাপতি। এই সুযোগে হাইকোর্টে মাউশির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট করেন ওই প্রধান শিক্ষক। চলতি বছর ১৫ জানুয়ারি রিটের শুনানি শেষে মাউশির নির্দেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন মাউশির মহাপরিচালক। পরে এ বছরের ২০ মার্চ হাইকোর্টের আদেশ আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। এ সময়ের মধ্যে এই আদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি ও আপিল নিষ্পত্তির আবেদন করেন মাউশির মহাপরিচালক। আবেদনটি আপিল বিভাগের শুনানির অপেক্ষা তালিকায় আছে।

অন্যদিকে আপিল বিভাগের সর্বশেষ অফিস আদেশ অনুযায়ী কোর্টের আগের আদেশের মেয়াদকাল বেড়ে শুনানির তারিখ পর্যন্ত বলবৎ বলে গণ্য হয়। আশানুরূপ নিয়োগ বাতিলের নির্দেশসহ মাউশি থেকে পাঠানো চিঠি এখন কার্যকর আছে। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।

মাউশি বরিশাল অঞ্চলের মহাপরিচালকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ কমিটি গঠিত হলে সেই কমিটির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন একজন অভিভাবক সদস্য। সেই বছরের ১৩ ডিসেম্বর সেই রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট তার অভিযোগ নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। এ আদেশ উপেক্ষা করে ১৫ ডিসেম্বর নিয়োগ সম্পন্ন করে কমিটি। সেদিন সকালে ২৭ জন নিয়োগ প্রার্থী পরীক্ষা কেন্দ্রে যান। হাইকোর্টের আদেশে পরীক্ষা হবে না বলে তাদের জানান নিয়োগ কমিটির সদস্য ও পটুয়াখালী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু সেদিনই গোপনে মাত্র পাঁচজনের পরীক্ষা নিয়ে এবং সন্ধ্যার মধ্যে তড়িঘড়ি করে খাইরুল আলমকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সাক্ষ্য ও নথিপত্রে এর প্রমাণ মেলে। বিষয়গুলো সাধারণ দৃষ্টিতেও অনিয়মের সংকেত দেয়।

সরেজমিন তদন্তে আটজন নিয়োগ প্রার্থীর অভিযোগে বর্ণিত অনিয়ম ও নিয়োগ বোর্ডের ত্রুটিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের কারণে নিয়োগ কার্যক্রম বিতর্কিত হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সই সঙ্গে নিয়োগ কার্যক্রম শতভাগ স্বচ্ছ হয়নি। এক্ষেত্রে জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, নিয়োগ কর্মকর্তা ও পটুয়াখালী জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের গাফিলতি ও ত্রুটির বিষয়টিও উঠে আসে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে।

এদিকে নিয়োগের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের একজন ওই স্কুলেরই সহকারী প্রধান শিক্ষক। তিনি অভিযোগ করায় তার বিদ্যালয় প্রদত্ত ভাতা বন্ধ করাসহ তার রুমের চাবি আটকে রাখার অভিযোগ আছে ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।

আব্দুর রশিদ সরদার মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহকারী প্রধান শিক্ষক ও নিয়োগের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী সেলিম রাজা বলেন, ৩ তারিখ (০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪) ইউএনও স্যারকে সব কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়েছি৷ তিনি আমাকে রিসিভ কপিও দিছেন। কিন্তু ব্যবস্থা নিবেন বলে আমাকে দীর্ঘদিন ঘুরাচ্ছেন। নিয়োগের বিরুদ্ধে আবেদন করার অপরাধে, আমার বিদ্যালয় প্রদত্ত ভাতা বন্ধ রেখেছেন খাইরুল আলম। আমার কক্ষের চাবিও তিনি আটকে রেখেছেন৷ অভিযোগকারী বাকি সাতজনের রাগও তিনি আমার ওপরে ঝাড়ছেন মনে হয়। তিনি অবৈধভাবে চেয়ার দখল করে বসে থেকে আমাদের অত্যাচার করছেন।

অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মো. খাইরুল আলম বলেন, ষড়যন্ত্র করে আমার নিয়োগ বাতিলের চেষ্টা করা হচ্ছে। সুপ্রিমকোর্টের শুনানির পরে নিয়োগের বিষয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। আমি কখনো ঘুষ লেনদেন করিনি এবং করবও না। দলীয় পদ এই নিয়োগে সহযোগিতা করেছে কিনা প্রশ্নের জবাবে, আওয়ামী লীগের কোনো পদে তিনি নেই বলে দাবি করেন খাইরুল।

এদিকে বাউফল সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিটন মোল্লা নিশ্চিত করেছেন, প্রধান শিক্ষক খাইরুল তার রানিং কমিটির শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক।

পটুয়াখালী জেলা শিক্ষা অফিসার মুজিবুর রহমান বলেন, কোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের কিছু করার নেই।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সহকারী পরিচালক কাওছার আহমেদ জানান, ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কাজ চলছে। আইন শাখার মতামত ছাড়া এর বাইরে কিছু বলা সম্ভব না। তিনিই গত বছর নিয়োগ বাতিলের সেই চিঠিতে সাক্ষর করেছিলেন।

মাউশির আইন শাখার শিক্ষা অফিসার মো. আল আমিন সরকার বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ও আইনানুসারে, প্রধান শিক্ষক খাইরুল আলমের নিয়োগ যথাযথ না হওয়ায় তা বাতিলের জন্য মাউশির চিঠির কার্যক্রম চলছে। ইউএনও যদি কোর্টের কাগজ বুঝতে না পারেন, তাহলে তার উচিত এ বিষয়ে মাউশির কাছে জানতে চাওয়া। মাউশি অবশ্যই তাকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করবে।

এদিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ম্যানেজিং কমিটির সভা ডেকে সব কাগজ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বশির গাজী।

আরিফুল ইসলাম সাগর/এফআরএস