পর্যটন দিবস
পাহাড়ের পর্যটনে চলছে বিষাদের ছায়া, হতাশা কাটিয়ে ওঠার আশা
‘চলো দোতং পাহাড় জুম ঘরে, পূর্ণিমা রাত বর্ষা জুড়ে জীবন জুয়ার আসর বসাবো’ গানের মতো পর্যটকরাও সুযোগ পেলেই ছুটে আসেন পাহাড়ে। ইট পাথরের জটিল ধাঁধার শহর ছেড়ে স্বস্তি নিশ্বাস নেওয়ার অন্যতম স্থান হিসেবে পাহাড়কে বেছে নেন তারা। সবুজ পাহাড়ের সঙ্গে নীল আকাশে মেঘের মিতালি, আঁকাবাঁকা রাস্তা ও কাপ্তাই হ্রদের স্থির জলরাশির অপার সৌন্দর্য উদাস ভাবনায় রেখে দেয় পর্যটকদের।
বর্ষায় পাহাড় যেন নতুন যৌবন পায়। পানিতে টইটম্বুর থাকে কাপ্তাই হ্রদ, ঝিরি-ঝর্ণার স্বচ্ছ পানিতে গাঁ ভিজিয়ে জীবনের আনন্দে ভরে ওঠে মন। সাজেকের মেঘ ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেন পর্যটকরা। তাদের কাছে এ যেন ভিন্ন এক জগৎ। বারবার পর্যটকদের আসতে বাধ্য করে রূপের রানী রাঙামাটি।
বিজ্ঞাপন
তবে সাম্প্রতিক বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বিষাদময় করে তুলেছে পাহাড়ের পর্যটন খাত। এমন ঘটনায় পর্যটকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। বিভ্রান্তিতে পড়ছেন স্থানীয়রাও।
সাজেক বলতেই পর্যটকদের কাছে ছিল ভিন্ন এক অনুভূতির জায়গা। কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে গত তিন দিন মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করেছে প্রশাসন। বর্তমানে সাজেকে শূন্য পর্যটক, লোকসান গুনছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে পুরোনো রূপে ফিরবে পাহাড় এমন প্রত্যাশা পর্যটন সংশ্লিষ্টদের।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্ষায় পাহাড় নতুন রূপ ধারণ করে। নভেম্বর-ডিসেম্বর শীতের দিনে পর্যটনে ভরপুর থাকে সাজেক। তবে পাহাড়ের এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বিরূপ প্রভাব ফেলেছে দেশ জুড়ে। এতে কিছুটা ক্ষতি হলেও সব আগের মতো হবে বিশ্বাস তাদের। পাহাড়ে বাড়বে পর্যটক, পর্যটকরা মুগ্ধ হবেন প্রকৃতির রূপে।
তারা বলেন, পাহাড়ে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। নতুন পর্যটন স্থান তৈরি, তরুণ উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া সহজ করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি আইন ও নিরাপত্তার প্রতি জোর দিতে হবে। আর্থিক বিনিময়ের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা আরও বাড়ালে পাহাড়ে আরও বেশি পর্যটক বাড়বে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, রাঙামাটি শহরে ৫৫টি হোটেল-মোটেল আছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কারণে পাহাড়ের হোটেল-মোটেলগুলো প্রায় শূন্য। বুকিং হয়েছে মাত্র ১০-২০ শতাংশের মতো। অথচ প্রতি বছর এ সময়ে পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকে রাঙামাটি। বিগত একমাস ধরে সিম্বল অব রাঙামাটি খ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজেও হ্রদের পানি উঠে গেছে। পর্যটকরা রাঙামাটি এলেই এ স্থানটি ঘুরে দেখেন। কিন্তু সেটি ডুবে যাওয়ায় ঘুরতে আসা পর্যটকরাও হতাশ হচ্ছেন।
এদিকে মেঘের রাজ্য সাজেক পর্যটক শূন্য। সাজেকের বুকে চলছে সুনশান নিরবতা। পর্যটক না থাকায় নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছে সাজেক। সেখানে অনেকেই রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এক দশক আগেও বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটত পাহাড়ে। এখন তা তুলনামূলকভাবে কম। তাই তাদের আসার পথ সহজ করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা জরুরি বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
সাজেকের সেনিলুসাই রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্টের মালিক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, বর্তমানে সাজেকে কোনো পর্যটক নেই। একদম শূন্য। অনেকে রিসোর্ট-রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পেলে সাজেক আবারও পর্যটকের পদচারণায় মুখর হবে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন
রাঙামাটি আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মো. মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, প্রতি বছর পর্যটন দিবস আসে, পালন হয়। কিন্তু রাঙামাটিতে পর্যটন খাত নিয়ে সবার সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় নতুন পর্যটন স্পষ্ট গড়ে উঠছে না রাঙামাটিতে। অথচ পাশের বান্দরবান-খাগড়াছড়িতে পর্যটকের আকৃষ্ট করার জন্য নতুন স্পট হয়েছে। সবার সমন্বয় এবং সঠিক পরিকল্পনা না থাকার কারণে পর্যটন খাতে রাঙামাটি পিছিয়ে পড়ছে। পর্যটনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
পাহাড়ের পর্যটন খাতের নারী উদ্যোক্তা গরবা গুদি রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী নিলা চাকমা বলেন, রাঙামাটি পর্যটন সংশ্লিষ্ট একটি এলাকা। এখানকার পর্যটন খাত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। সেটি না হলে নতুন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে চাইবেন না। পর্যটন খাতে আলাদা ঋণ সুবিধার পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের পর্যটকদের প্রতি আন্তরিক হতে হবে। তাহলেই পর্যটন খাত এগিয়ে যাবে।
রাইন্ন্যা টুগুন ইকো রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ললিত সি চাকমা বলেন, এখানে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। পাহাড়ের পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, পর্যটকদের জন্য আর্থিক লেনদেন বিনিময় সহজ করতে হবে। তাহলে অন্যান্য এলাকা মতো এখানেও দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। এখানকার অর্থনীতি চাঙা হবে।
রাঙামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক অলক বিকাশ চাকমা বলেন, বর্তমানে রাঙামাটিতে পর্যটক খুব কম। ঘুরতে আসা পর্যটকদের ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে মাত্র ২০ শতাংশের মতো বুকিং হয়েছে। কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে গেলে ঝুলন্ত ব্রিজ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। আশা করছি, পর্যটন মৌসুমে আশানুরূপ পর্যটক পাব।
জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খান বলেন, নানান সীমাবদ্ধতার পরেও পাহাড়ে পর্যটন খাতে প্রচুর সম্ভাবনা আছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পর্যটক শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারলে এখানে দেশি-বিদেশি প্রচুর পর্যটক আসবে। এই অঞ্চলের মানুষের সোর্স অব ইনকাম কম। তাই পর্যটন শিল্পকে আধুনিকায়ন করা গেলে অর্থনৈতিক গতি বৃদ্ধি পাবে।
মিশু মল্লিক/এফআরএস