২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে এদিন দুপুরে বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে মহালয়ে যাওয়ার সময় ৭২ জন যাত্রীসহ নৌকাডুবি হয়। ওই ঘটনায় ৭১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কেবল উদ্ধার হননি সুরেন্দ্র নাথ রায়।

নিখোঁজ সরেন্দ্র নাথ রায় সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া এলাকার শান্তি রানীর স্বামী। স্বামীর ছবি নিয়ে এখনও বিলাপ করছেন তিনি। মানুষটা সেদিন দুপুরে সাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলেন। এরপর আর ফিরে আসেননি। একদিন, দুদিন— এভাবে দুই বছর পার হলেও তার কোনো খোঁজ নেই। এখনও তার অপেক্ষায় বিয়োগান্ত পরিবারটি।

নৌকাডুবিতে সুরেন্দ্র নাথ রায়সহ পরিবারটির সাত সদস্য নিখোঁজ হন। পরে দুই বোনসহ পাঁচজনের মরদেহ পেলেও বাবাকে পাননি স্বপন চন্দ্র বর্মণ। মরদেহটি পেলে হয়তো নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন, করতেন সৎকার।

ওই ঘটনায় একই পরিবারের চারজনকে হারান হেমন্ত রায়। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের চার সদস্যকে হারানোর বেদনায় আজও কাতর তিনি। মা-বাবাসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে হারান বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী এলাকার উজ্জ্বল কুমার রায়। নৌকায় স্বামী হিমালয়ের সঙ্গে যাত্রী ছিলেন নববধূ বন্যা রানী। নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হলেও স্বামীকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে নির্বাক তিনি।

নৌকাডুবিতে সুরেন্দ্র নাথ রায়সহ পরিবারটির সাত সদস্য নিখোঁজ হন। পরে দুই বোনসহ পাঁচজনের মরদেহ পেলেও বাবাকে পাননি স্বপন চন্দ্র বর্মণ। মরদেহটি পেলে হয়তো নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন, করতেন সৎকার

নদীপাড়ে হিমালয়ের বোন নীতি রানীর কান্না কাঁদিয়েছিল সবাইকে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলের মতো কেঁদে ছিলেন হিমালয়ের মা-বাবা। নৌকাডুবি ট্র্যাজেডিতে দুই মেয়েকে হারান কাজলদিঘী গ্রামের বাসিন্দা ধীরেন চন্দ্র।

দেবীগঞ্জের শালডাঙা হাতিডোবার ষাটোর্ধ্ব জলেশ্বরী রানীর গগনবিদারী আর্তনাদে স্তব্ধ হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকা। একসঙ্গে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়ে ফেলেন তিনি।  মন্দিরে যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে যাওয়ার সেই দৃশ্য নিজ চোখেই দেখেছিলেন। পাঁচ বছর বয়সী দীপংকর ও দেড় বছরের নাতি বিষ্ণুর স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করেছেন রাতভর। মা-বাবার সঙ্গে মহালয়া দেখতে যাচ্ছিল তিন বছর বয়সী দীপু। নৌকাডুবিতে নিজে বেঁচে ফিরলেও মা রুপালি রানী ফিরেছেন লাশ হয়ে।

একই পরিবারের চারজনকে হারান হেমন্ত রায়। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের চার সদস্যকে হারানোর বেদনায় আজও কাতর তিনি। মা-বাবাসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে হারান বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী এলাকার উজ্জ্বল কুমার রায়। নৌকায় স্বামী হিমালয়ের সঙ্গে যাত্রী ছিলেন নববধূ বন্যা রানী। নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হলেও স্বামীকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে নির্বাক তিনি

এভাবেই স্বজন হারিয়েছেন অনেকে। ঘটনার পর বছর, বছরের পর বছর ঘুরে এলেও চোখের সামনে ভয়াল সেই দৃশ্য এখনও ভুলতে পারছেন না কেউ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বিপাকে পড়েন অনেকে।

মা-বাবাসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে হারানোর শোক এখনও ভুলতে পারেননি মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী এলাকার উজ্জ্বল কুমার রায়। সেদিনের নৌকাডুবিতে বাবা-মা, পিসি, মাসি, নানা ও নানার বেয়াইকে হারান তিনি। বাবা-মায়ের কথা মনে হলেই ছবি হাতে নিয়ে হাত বুলিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেন। ভাইসহ নিজের লেখাপড়ার খরচ, সংসারের খরচ, কৃষিকাজ সবই এখন একা সামলাতে হয় তাকে।

পরিবারের প্রধানকে হারিয়ে এখন সংসারের হাল ধরেছেন ফুলমতি রানী। স্বামীকে হারিয়ে জীবনের খেই হারিয়ে ফেলেছেন। ঘটনার দুই বছর পার হলেও তার খোঁজ রাখেনি কেউ। একটু আক্ষেপ তো আছে। তারপরও জীবন-সংগ্রামে নেমে দুই সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে সময় পার হচ্ছে তার।

মা-বাবাসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে হারানোর শোক এখনও ভুলতে পারেননি মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী এলাকার উজ্জ্বল কুমার রায়। সেদিনের নৌকাডুবিতে বাবা-মা, পিসি, মাসি, নানা ও নানার বেয়াইকে হারান তিনি। বাবা-মায়ের কথা মনে হলেই ছবি হাতে নিয়ে হাত বুলিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেন। ভাইসহ নিজের লেখাপড়ার খরচ, সংসারের খরচ, কৃষিকাজ সবই এখন একা সামলাতে হয় তাকে

নৌকাডুবির ওই ঘটনায় কেউ হারিয়েছেন আদরের সন্তান, কেউ বাবা, কেউবা মা; কেউ হারিয়েছেন আপন বোন কিংবা নিকটাত্মীয়। কেউ কেউ হারান পরিবারের তিন থেকে চারজন সদস্য। স্বজন হারানোর শোক এখনও ভুলতে পারছে না পরিবারগুলো।

কী ঘটেছিল সেদিন

প্রতি দুর্গাপূজার প্রাক্কালে দেবী দুর্গাকে আমন্ত্রণ জানাতে বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বদ্বেশরী মন্দিরে আয়োজন করা হয় বিশাল ধর্মসভা। দুর্গাপূজার আগে সেই ধর্মসভায় যোগ দিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা করতোয়া নদী পার হতে আউলিয়া ঘাটে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত একটি নৌকায় চড়েন। নৌকায় শতাধিক যাত্রী থাকায় তা ছিল ধারণক্ষমতার বাইরে। নৌকাটি কিছু দূর যেতেই ডুবে যায়। এ ঘটনায় কিছু লোক সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও নারী ও শিশুরা পানিতে তলিয়ে যায়। স্থানীয়রা দ্রুত উদ্ধারে নামেন। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। একে একে উদ্ধার করা হয় ৬৯টি মরদেহ। কয়েকদিন পর উদ্ধার হয় আরও দুজনের মরদেহ। নিখোঁজ থেকে যান একজন।

উদ্ধার হওয়া ৬৮ জনই সনাতন ধর্মের। একজন ছিলেন মুসলিম, ডুবে যাওয়া নৌকার মাঝি। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো পঞ্চগড়।

নৌকাডুবির ঘটনায় নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক শফিকুর রহমান বাদী হয়ে ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার, মাঝি বাচ্চু মিয়া ও মাঝি রবিউল ইসলামকে অভিযুক্ত করে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নৌযানের আকার-আকৃতি বিবেচনায় ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন, নৌযানের বৈধ, চালক রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে সনদ না থাকা, নৌযানে সনদধারী মাস্টার, সুকানিও গ্রিজারনা রেখে নৌযান চালানো, ইজারা চুক্তি মোতাবেক নিরাপত্তাসামগ্রী ও জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম না রাখা এবং চালকের অদক্ষতাকে দায়ী করা হয়।

ঘটনার ছয় মাস পর ১৪ মার্চ মামলার আসামি ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার ও ঘাটের মাঝি (নৌকাচালক) বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।

নৌকাডুবির ঘটনায় সাবেক রেলমন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন বোদা মাড়েয়ার করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে একটি ওয়াই আকৃতির ব্রিজ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতির দুই বছরের মাথায় মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়াঘাটে ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গত বছরের ১৮ অক্টোবর ৮৯১ মিটার পিসি গার্ডার ওয়াই আকৃতির সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে কাজ শুরু হয়। ডিসেম্বরে নদীর ওপর দৃশ্যমান হয় সেতু। যদিও সেতুর নির্মাণকাজ এখনও চলমান।

ঘাটে সেতু নির্মাণ নিয়ে কথা হয় নৌকাডুবিতে দুই স্বজন হারানো চন্দ্র মোহন বর্মণের সঙ্গে। তিনি বলেন, সেদিন মহালয়ায় যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে ৭২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আমার ভাতিজা ও তার স্ত্রী তিন সন্তান রেখে নৌকাডুবিতে মারা যান। ওই ঘটনা এখনও ভুলতে পারছি না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই মাড়েয়া ঘাটে করতোয়া নদীতে ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। এখন সেতুটি নির্মাণ হচ্ছে। এটি যদি আগে নির্মাণ হতো তাহলে নিরীহ মানুষগুলোর মৃত্যু হতো না।

এসকে দোয়েল/