হাজারদুয়ারি প্রাসাদ শুধু ভারতের মুর্শিদাবাদেই নয় রয়েছে বাংলাদেশেও। বিষয়টি অনেকেরই  হয়তো অজানা। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার এক নিভৃত পল্লিতে এর অবস্থান। ৫০ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে জমিদারবাড়িটি। তবে অনাদরে-অবহেলায় দিনে দিনে হারিয়ে গেছে এর ঐতিহ্য। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ আবস্থায় পড়ে আছে শত বছরের পুরানো এই জমিদারবাড়িটি।

স্থানীয়রা জানায়, বিভিন্ন সময় স্থানীয় সংসদ সদস্যরা এই জমিদারবাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের কথা বললেও তা করেনি কেউই। ফলে দিনে দিনে জমিদারবাড়িটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। জমিদারবাড়ির ঐতিহ্যের কথা জেনে দূরদূরান্ত থেকে বাস, মাইক্রোবাস ও কারে চেপে দর্শনার্থীরা আসে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পিকনিক বাসও আসে। তবে জমিদারবাড়ির জরাজীর্ণ ও বেহাল অবস্থা দর্শনার্থীদের হতাশ করে। ঘোরাঘুরির পরিবেশ না থাকায় অনেকেই ফিরে যান বিকল্প কোনো জায়গায়।

এ নিয়ে স্থানীয়রা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, জমিদারবাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করা থাকলে দর্শনার্থীদের এভাবে ফিরে যেত হতো না। এটি সংস্কার করা হলে সরকার রাজস্ব পাবে। এটিও একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে। একই সঙ্গে দর্শনার্থীরা এলে এই এলাকার 
অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে।

জানা গেছে, রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে বাগমারা উপজেলার যোগীপাড়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়ন ঘেঁষে একদিকে নাটোরের নলডাঙ্গা, অন্যদিকে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার যোগীপাড়ার বীরকুৎসা গ্রামে প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দোতলা হাজারদুয়ারি জমিদারবাড়ি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এই বিশাল রঙচটা জমিদারবাড়িটি নেই কোনো জানালা-দরজা। প্রতিটি দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। জানালা-দরজা এমনকি ইট পর্যন্ত বিভিন্ন সময় যে যার ইচ্ছেমতো নিয়ে গেছে। দোতলায় গেলে বেশ কিছু দরজা দেখতে পাওয়া যায়। তবে অনেক দরজাই ভেঙে পড়েছে।

জমিদারবাড়ির রান্না ঘরের অস্তিত্ব নেই। সেখানকার ইট খুলে নিয়ে চলে গেছে অনেকে। কোথাও কোথাও ছাদও বেঙে পড়েছে।  জমিদারবাড়ির ঘরগুলোতে এখন বিভিন্ন বয়সের ছেলে মাদকসেবন করে আর আড্ডা দেয়।

এক কালে কত নায়েব-পাইক-বরকন্দাজে মুখর ছিল বীরকুৎসা গ্রাম। ভবনের মাঝখান দিয়ে নিচতলা থেকে সিঁড়ি চলে গেছে দোতলার ছাদ পর্যন্ত। নিচতলা ও দোতলায় রয়েছে ছোট-বড় বেশ কিছু ঘর। এসব ঘরের সামনে ও পেছনে দুপাশ দিয়েই চলে গেছে লম্বা খোলা বারান্দা। 

দোতলায় ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দুটি করে চারটি ঘর। এসব ঘরের একদিকে দরজা, অন্য তিন দিকেই জানালা। জানালা দিয়ে আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা ছিল। চুন-সুরকির দালান। মূল ভবনের পূর্ব দিকে রয়েছে আরেকটি একতলা ভবন। ভবনটিতে মূল ভবনের নিচতলা ও একতলার ছাদ থেকেও যাওয়া যায়। এই পুরো প্রাসাদে দরজা ছিল এক হাজার। তাই এর নাম হয়েছিল হাজারদুয়ারি, এমন একটি গল্প প্রচলিত আছে বীরকুৎসায়। প্রতিটি দুয়ারে ছিল সেগুন কাঠের কারুকার্যখচিত দরজা। একসময় দরজাগুলো ছিল তিন স্তরে আবৃত। এর প্রথম স্তরে ছিল কাঠ। এরপর ছিল লোহার গ্রিল। শেষ দরজাটি ছিল দামি কাচের তৈরি। এখন সেগুলোর ভাঙা অংশই দেখা যায় শুধু। লোহার গ্রিল কিংবা কাচের কিছুই নেই এখন।

জমিদারবাড়ির ইতিহাস

নওগাঁর আত্রাইয়ের আমরুল ডিহির রাজা ছিলেন গোপাল ধাম। তিনি ভারতের কাশী থেকে আসা বীরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার মেয়ে প্রভাতী বালার বিয়ে দেন। বীরেশ্বরের ডাকনাম ছিল বিরুবাবু। ওই সময় পার্শ্ববর্তী বাগমারার বীরকুৎসা ছিল গোপাল ধামের একটি পরগনা। প্রভাতী বালা ও বিরুবাবুর বিয়ের পর রাজা গোপাল ধাম তার এই পরগনা মেয়ে-জামাতার নামে লিখে দেন। পরে শৌখিন রাজকন্যা প্রভাতী বালার পছন্দমতো বিরুবাবু বীরকুৎসায় এই অট্টালিকা গড়ে তোলেন। বিরুবাবুর দুই ভাই রামাবাবু ও দুর্গাবাবুও থাকতেন এই প্রাসাদে। জমিদার বিরুবাবুর ছিল হাতি ও ঘোড়া। হাতিতে চড়ে তিনি জমিদারি দেখাশোনা করতেন। খাজনা আদায়ের জন্য তার ছিল পর্যাপ্ত নায়েব-কর্মচারী। পাশেই ছিল খাজনা আদায়ের ঘর।

এখন এটি হয়ে গেছে ভূমি অফিস। আর জমিদারবাড়ির পূজামণ্ডপটি হয়েছে পোস্ট অফিস। প্রাসাদের পশ্চিমে খিড়কি দরজা পার হয়ে শানবাঁধানো পুকুর। এই পুকুরে শুধু জমিদার পরিবারের সদস্যরাই স্নান করত। প্রাসাদের ভেতরে আছে জলসাঘর। এখানে গান বাজনা করতে আসত কলকাতার ভোলানাথ অপেরা। প্রাসাদের সামনে ছিল ফুলের বাগান। এখন সেখানে দোকানপাট। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বিশাল অট্টালিকা ও জমিজমা ফেলে বিরুবাবু সপরিবারে ভারতের হুগলি জেলার চন্দননগরে চলে যান। এরপর প্রাসাদের সম্পত্তি চলে যায় সরকারের হাতে। এটি জমিদারবাড়ি হলেও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে এর নাম ‘বীরকুৎসা রাজবাড়ী’।

জমিদারবাড়িতে বেড়াতে এসেছেন ঢাকার মীরপুর থেকে সাইফুল ইসলাম ও রকিবুল ইসলাম বলেন, নাম শুনেছিলাম হাজারদুয়ারি জমিদারবাড়ির। কখনও আসা হয়েছিল না। এসে দেখি জরাজীর্ণ আবস্থায় পড়ে আছে। এটা ঘুরে দেখারও পরিবেশ নেই। অথচ আমাদের দেশের অনেক মানুষ প্রতিবছর ভারতের মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ দেখতে যায়। এই হাজারদুয়ারি জমিদারবাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হলে অনেক দর্শনার্থী আসবে।

স্থানীয় বাসিন্দা কার্তিক বলেন, এখন দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে দেখতে। প্রতিবছর কমপক্ষে চার থেকে ৫ হাজার মানুষ দেখতে আসে এই জমিদারবাড়িটি। কিন্তু আসার পরে মানুষের মন খারাপ হয়ে যায়। জরাজীর্ণ জমিদারবাড়ি দেখে বলে এ কি দেখতে আসলাম? অনেক সময় স্কুল-কলেজ থেকে পিকনিক আসে। তারা এমন পরিবেশ দেখে গাড়িয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যায়।

এ বিষয়ে বীরকুৎসা অবিনাশ স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল আলীম বলেন, ১০০ বছরের বেশি পুরানো জমিদারবাড়ি। একসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্ডারে ছিল। এখন ভূমি অফিসের আন্ডারে পুরো জমিদারবাড়ি। জমিদারবাড়িটি জরাজীর্ণ আবস্থায় পড়ে আছে। সংস্কার জরুরি দরকার।
 
বিষয়টি নিয়ে বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম বলেন, সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ছাড়াও ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।


এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ, বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ড. আহমেদ আবদুল্লাহ বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নেই বাগমারার এই জমিদারবাড়িটি। তবে পুরানো জমিদারবাড়িটি হাজারদুয়ারি নামেও পরিচিত।  

যেভাবে যাওয়া যায়

রাজশাহী শহর থেকে বাসে বাগমারা উপজেলা সদর ভবানীগঞ্জে আসার পর অটোরিকশায় হাজারদুয়ারি জমিদারবাড়ি যাওয়া যায়। ভবানীগঞ্জ থেকে এটি ১৮ কিলোমিটার দূরে। নওগাঁ কিংবা নাটোর থেকে নলডাঙ্গা হয়েও সড়কপথে যাওয়া যায়। জমিদারবাড়ির পাশেই রয়েছে বীরকুৎসা রেলস্টেশন। এই স্টেশন থেকে হেঁটে কিংবা ভ্যান-অটোরিকশায় যাওয়া যাবে জমিদারবাড়ি দেখতে। তবে এই স্টেশনে সব ট্রেনের যাত্রাবিরতি নেই। নওগাঁর আত্রাই বা নাটোরের মাধনগর স্টেশনে নেমে অন্য বাহনে জমিদারবাড়ি যাওয়া যাবে আধা ঘণ্টায়।

আরকে