পরিবারের দাবি
গণপিটুনি নয়, দোকান থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয় মামুনকে
খাগড়াছড়িতে ফার্নিচার ব্যবসায়ী মো. মামুনকে চোর সন্দেহে গণপিটুনি নয়, তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার। তাকে হত্যার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংস ঘটনার সূত্রপাত হয়। মামুনকে হত্যার একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর এমনটাই জানা গেছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির শালবাগান এলাকার বাসিন্দা মো. মামুনকে জেলা সদরের মধুপুর এলাকার একটি বাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। পরে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় নিউজিল্যান্ড এলাকার সুইমিং পুলের সামনে ফেলে রাখা হয়। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বিজ্ঞাপন
প্রত্যক্ষদর্শী এবং মামুনের পরিবারের দাবি- চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নয়, দোকান থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে মামুনকে হত্যা করা হয়েছে।
সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী মামুনের দোকানের কর্মচারী শাহীন। তাকেও তুলে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। একই ঘটনায় শালবাগান এলাকার আরও দুইজনকে তুলে নিয়ে মারধর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মারধরে আহত হয়ে শাহীন খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
শাহীন গুইমারা উপজেলার পশ্চিম বড়পিলাক এলাকার আব্দুল কাদেরের ছেলে। সে মামুনের ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী ছিল। ঘটনার তিন-চার দিন আগে দোকানে কাজে যোগ দেয় শাহীন।
শাহীন জানান, মঙ্গলবার রাতে শালবাগানে মা ফার্নিচার মার্টে (মামুনের দোকান) ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শাহীন। এ সময় দোকানের বাহিরে একজন মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন এবং মামুনকে স্বাভাবিকভাবে দোকান থেকে ডেকে বের করে নিয়ে যান। মামুন বাসায় চলে গেছে ভেবে ঘুমিয়ে পড়েন শাহীন। পরবর্তীতে ভোরে কয়েকজন এসে তাকেও তুলে নিয়ে যায়। একটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেও চুরির সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে বলে মারধর শুরু করে। শাহীন এ বিষয়ে কিছুই জানেন না জানিয়ে মামুনের সাথে কথা বলতে চান। পরে মামুনকে ঘরের মেঝেতে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তাকে আরেকটি রুমে নিয়ে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে আটকে রাখা হয়। পরবর্তীতে মামুনের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নিহত মামুনের স্ত্রী মুক্তা আক্তার বলেন, আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মামুনকে দোকান থেকে ডেকে নিয়ে গেছে পার্শবর্তী এলাকার শাকিল। মামুনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়াসহ বিষয়টি পরিবারকে জানিয়েছিল শাকিল। ছড়িয়ে পরা ভিডিওতে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে শাকিলকে দেখা গেছে। ভিডিও প্রকাশের পর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছে শাকিল। তাকে আটক করলেই মূল রহস্য বেড়িয়ে আসবে।
গত বুধবার হাসপাতালে সাংবাদিকদের শাকিল জানিয়েছিলেন, শাকিল অ্যাম্বুলেন্স চালক। তাকে ভোর ৪টার দিকে একজন মুঠোফোনে কল দিয়ে জানায় একজন রোগীকে হাসপাতালে আনতে হবে। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত মামুনকে দেখতে পান। মামুন তার পরিচিত হওয়ায় তিনি ঘটনাস্থল থেকে ফিরে এসে মামুনের পরিবারকে খবর দেন। পরবর্তীতে তিনি পরিবারের লোকজনসহ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
এদিকে মামুন কার বাড়িতে কি চুরি করে মারধরের শিকার হয়েছেন তা এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি জেলা পুলিশের কোনো কর্মকর্তা। তবে পুলিশ এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলাচ্ছে।
মামুন হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এখনো কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। আসামিদের আটকের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল বাতেন মৃধা। সহিংসতায় খাগড়াছড়ি সদরের তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে খাগড়াছড়ি সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মামুন হত্যার ঘটনায় স্ত্রী মুক্তা আক্তার বাদী হয়ে খাগড়াছড়ি সদর থানায় অপহরণের পর হত্যার অভিযোগে মামলা করেছেন। মামলায় তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জন উপজাতি এবং বাঙালিকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় উল্লেখিত আসামিরা হলেন- জেলা সদরের শালবাগান এলাকার মো. শাকিল, খাগড়াছড়ি পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রফিকুল আলম এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল আলম।
মামুন মধ্য শালবাগান এলাকার বাসিন্দা। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন মামুন। দুই মেয়ে, স্ত্রী এবং বিধবা মাকে নিয়ে থাকতেন নিজ বাড়িতে। কয়েক বছর আগে মামুনের বাবা মারা গেছেন। ফার্নিচারের ব্যবসা করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন মামুন। তার মৃত্যুতে পরিবারটি এখন বিপাকে পড়েছে। বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়ের বয়স ৬ বছর। বাবা হত্যার বিচার চেয়েছে তার মেয়েরা।
প্রসঙ্গত, মামুন হত্যার প্রতিবাদ এবং দোষীদের শাস্তির দাবিতে গত বৃহস্পতিবার দীঘিনালা কলেজের বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা মিছিল বের করেন। মিছিলে হামলার ঘটনা ঘটলে পরবর্তীতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সহিংসতায় দীঘিনালা লারমা স্কয়ারের শতাধিক বাঙালি এবং পাহাড়ি ব্যবসায়ীদের দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এ ঘটনার রেশ ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়জুড়ে। খাগড়াছড়ি সদরে তিনজন এবং রাঙ্গামাটিতে একজনের মৃত্যু ঘটে সহিংসতায়। আহত হন শতাধিক।
মোহাম্মদ শাহজাহান/আরএআর