নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মদন কুমার রায়ের অফিসের কাজের জন্য দেওয়া সরকারি মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করছেন তার শ্যালক। সেই মোটরসাইকেল চালিয়ে ওই কর্মকর্তার শ্যালক শংকর সরকার প্রতিদিন তার কর্মস্থলে যান। গাড়ি রাখেনও নিজ বাড়িতে। এমনকি ওই গাড়ির তেল খরচও চলে অফিসের টাকায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মদন কুমার রায় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে দুই বছর আগে এ উপজেলায় যোগদান করেন। উপজেলার গয়াবাড়ী এলাকায় তার শ্বশুরবাড়ি। তার শ্যালক শংকর সরকার উপজেলার দক্ষিণ গয়াবাড়ী শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। সরকারি মোটরসাইকেল নিয়ে নিজ বাড়ি থেকে কর্মস্থলে যাতায়াতে করেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে আত্মীয়করণ ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। 

প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য লাল রঙের একটি ১০০ সিসি মোটরসাইকেল প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ডিমলা উপজেলার জন্য বরাদ্দ রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করবেন ভেটেরিনারি সার্জন। সরকারি কাজ ছাড়া ব্যক্তিগত কাজে গাড়ি ব্যবহারের কোনো নিয়ম নেই। অথচ প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এ উপজেলায় যোগদানের পর থেকে তার শ্যালক অফিসের সরকারি মোটরসাইকেলটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। ওই গাড়ি নিয়ে তিনি প্রতিদিন নিজ বাসা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নিজ কর্মস্থলে যাতায়াত করেন।

তিন থেকে চার দিন ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সরকারি মোটরসাইকেলটি নিয়ে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাতায়াত করেন সহকারী শিক্ষক শংকর সরকার। বিদ্যালয়ের মাঠে একটি টিনের চালার নিচে গাড়ি রেখে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করান। ছুটি শেষে আবার মোটরসাইকেলটি নিয়ে বাড়িতে চলে যান তিনি। 

শুধু তাই নয়, সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে গবাদিপশু বিতরণের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন খামারি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রান্তিক খামারিদের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা বিতরণে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনদের নাম ব্যবহার করেন ওই কর্মকর্তা। 

এমনকি প্রতিটি উপকারভোগী পরিবারকে সর্বনিম্ন ১২০ কেজি ওজনের গরু দেওয়ার কথা থাকলেও ৫০-৬০ কেজি ওজনের ছোট ও রোগাক্রান্ত গরু দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৭ কেজির জায়গায় ৩-৪ কেজির ভেড়া ও ৮ কেজির জায়গায় ২-৪ কেজির ছাগল মিলেছে। এ ছাড়া একাধিক সচ্ছল ব্যক্তিও অনুদানের পশু পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

উপকারভোগীরা জানান, গবাদিপশুগুলো রুগ্ন ও হাড্ডিসার ছিল। বরাদ্দের অর্ধেক দামেও কেনা হয়নি এসব প্রাণী। বাড়িতে আনার পর অনেকের পশু মারা গেছে। 

উপজেলার ঠাঁটারিপাড়া গ্রামের উপকারভোগী স্বপ্না বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে যে দুটো ছাগল দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর ওজন ২ কেজির বেশি হবে না। অসুস্থ ছাগল দুটো বাড়িতে আনার ১০ দিনের মধ্যে মরে গেছে।

একই অভিযোগ করেন উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২০ জন উপকারভোগী। তাদের অভিযোগ, সহজ-সরল পেয়ে তাদের ঠকানো হয়েছে। তাদের অনেকে এসব পশু নিতে চাননি। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এগুলো নিতে বাধ্য করেন। 

সরকারি গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে শংকর সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোটরসাইকেলটি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের। তবে গত এক মাস যাবৎ আমি ব্যবহার করছি। বিষয়টি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মদন কুমার জানেন। তিনি আমার বোন জামাই। অন্য কেউ সরকারি কার্যালয়ের মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে পারেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ঠিক হয়নি। গাড়িটি ফেরত দিয়ে দেব।

সরকারি গাড়ি তার স্বজনদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মদন কুমার রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, গাড়িটির যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তাই মেরামত করে আপাতত নিজ জিম্মায় রেখেছি। কয়েক দিন থেকে শ্যালক গাড়িটি ব্যবহার করছে।

গবাদিপশু বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে মদন কুমার রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, দরপত্র অনুযায়ী গবাদিপশুর ওজন কম হওয়ায় তখন বিতরণকাজ স্থগিত করেছিলাম। পরে উপকারভোগীদের দাবিতে কম ওজনের পশুই বিতরণ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় মাঠপর্যায়ে তদন্ত করেছেন কিন্তু আমরা কোনো নির্দেশনা পাইনি।

এ বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সিরাজুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি গাড়ি নিয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাইরে যাওয়া বা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের বিধান নেই। তারপরও যদি এমন করে থাকে তাহলে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শরিফুল ইসলাম/আরকে