বিয়ের বছর কয়েক পর হোসেন-রাশিদা দম্পতির সংসার আলোকিত করে জন্ম হয় মো. আমির সরকার। জন্মের পরপরই তারা বুঝতে পারেন আমির দৃষ্টিহীন। তার চিকিৎসার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা চেষ্টা করেও দৃষ্টি ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেই ধাক্কা না সামলাতেই জন্ম নেন হাসিনা বেগম (৩২)। তার জন্মের দুই বছর পর জন্ম নেন নাছরিন আক্তার (২৫)। সবশেষ জন্ম নেন জাকির হোসেন (২২)। ভাগ্য কতটা বৈপরীত্য আচরণ করেছে, কারণ শেষ তিন সন্তানও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।

গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার উজিলাব। এই গ্রামেই স্ত্রী রাশিদাকে নিয়ে সুখের সংসার পেতেছিলেন হোসেন আলী। কিন্তু পরিবারের সন্তান-নাতি-নাতনি মোট ৮ সদস্য যখন দৃষ্টিহীন, তখন একজন আরেকজনের দুঃখ অন্তর দিয়ে বোঝা ছাড়া আর কীই-বা করার আছে তাদের? একমাত্র মা রাশিদাকেই দেখতে হয় সবার নিদারুণ কষ্ট।

এদিকে পরবর্তী প্রজন্ম যাতে আলোর মুখ দেখতে পায়, সে জন্য ভাই-বোনেরা বিয়ে করে সংসারও করেছিলেন। তাতেও দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি। হাসিনা বেগমের ছেলে মারুফ ও মেয়ে রুপাও জন্মের পর হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। নাসরিনের সন্তান সিফাতও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। জাকিরের মেয়ে জোনাকিও বাদ যায়নি, সে-ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতার শিকার।

এমনভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতার ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে আমিরের ভাই-বোনের পরিবারটি।

এই ঢোল বাজিয়ে গান গেয়ে সামান্য কিছু আয় করেন আমির হোসেন 

একবুক আক্ষেপ নিয়ে আমির হোসেনের মা রাশিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে জানান, আমির ও জাকির, আমিরের স্ত্রী শিউলী ও নাতনি জোনাকীকে নিয়ে তার সংসার। তিনি ছাড়া সংসারের সবাই দৃষ্টিহীন। কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না কেউ। আমির সরকার পেশায় ঢোলবাদক। আশপাশের এলাকার বাউল আসরে ঢোল বাজিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে সংসার। কিন্তু করোনার কারণে এখন বাউল আসর বন্ধ থাকায় বন্ধ হয়ে যায় আয়। তাই খেয়ে না-খেয়ে দিন পার করছেন তারা।

তিনি আরও জানান, তার দৃষ্টিহীন মেয়ে হাসিনার ১ বছর বয়সী ছেলে মারুফ ও ১৩ বছর বয়সী মেয়ে রুপা এবং মেয়ে নাসরিনের ঘরে জন্ম নেওয়া ১০ বছর বয়সী ছেলে সিফাত নাহিদও দৃষ্টিহীন। জন্মের পর থেকে তারা একপ্রকার অন্ধত্বের অভিশাপ নিয়ে জীবনযাপন করছে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ঢোলবাদক আমির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ অন্ধ বলে জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ আর সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখতে পারিনি। প্রিয় মায়ের মুখটাও দেখতে পাইনি। এলাকার বাউলগানের আসর ও স্থানীয় বাজারগুলোয় ঢোল বাজিয়ে দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো আয় হতো। এ নিয়ে কোনোমতে চলত আমার সংসার। কারণ, পাঁচ সদস্যের সংসারে পুরো দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। কিন্তু এক দিন গানের ডাক না পড়লে না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়।

পরিবারে একমাত্র দৃষ্টি সচল মা রাশিদার। তাকেই দেখতে হয় সবার কষ্ট

তিনি বলেন, আমার স্ত্রীও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। আমার ১০ বছর বয়সী একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। সে-ও রাতকানা রোগে আক্রান্ত। ধীরে ধীরে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে তার। আমাদের দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই।

নিজে না খেয়ে থাকলেও সমস্যা হতো না, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের কথা চিন্তা করলে কষ্টে বুকটা ফেটে যায়, অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, স্ত্রী, মা ও ছেলেকে নিয়ে অনেকটা অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটাই। কয়েকজনের প্রতিবন্ধী ভাতা দিয়ে এখন আর চলা যাচ্ছে না। তাই সরকারের কাছে আবেদন, চোখের আলো ফেরাতে নয়, তিন বেলা পরিবার-পরিজন নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

শ্রীপুর পৌরসভার মেয়র আনিছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, একটি পরিবারের সবাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতার শিকার, এটা সত্যিই হতাশাজনক। মানবিকতা দিয়ে এ পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। পরিবারের পাঁচ সদস্যের নাম সরকারি ভাতায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন তিনি। এবার তাদের বাড়িঘর সংস্কারে সরকারি সহায়তার বিষয়েও উদ্যোগ নেবেন বলে জানান মেয়র।

এনএ